—প্রতীকী ছবি।
অতি অভ্যাসে সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে যায়, এমনকি ঘৃণাভাষণও। তবু ভারতীয় নাগরিকদের আতঙ্কের বোধটি সম্ভবত এখনও নির্বাপিত হয়নি বলেই হয়তো এই পরিসংখ্যানে আতঙ্ক জাগতে বাধ্য— ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট ৬৬৮টি নথিভুক্ত ঘৃণাভাষণের ঘটনার কথা জানা গিয়েছে। আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি-র একটি গবেষণা সংস্থা ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নেমে আসা ঘৃণাভাষণের ঘটনার হিসাব কষে দেখিয়েছে, মোট ঘটনার প্রায় ৭৫ শতাংশই ঘটেছে নানা বিজেপি-শাসিত রাজ্য, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং দিল্লিতে— যার পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটি কেন্দ্রাধীন। সংখ্যাগুরুত্বের দিক থেকে তালিকা করলে মহারাষ্ট্র, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, কর্নাটক আছে প্রথম দিকে; এবং দেখা যাচ্ছে, বছরের প্রথমার্ধের তুলনায় দ্বিতীয়ার্ধে ঘৃণাভাষণের ঘটনা মাত্রা ছাড়াচ্ছে, তুঙ্গ স্পর্শ করেছে অগস্ট থেকে নভেম্বরে, যখন রাজস্থান মধ্যপ্রদেশ তেলঙ্গানা ছত্তীসগঢ়ে চলছে বিধানসভা নির্বাচন। আর কে না জানে, ভোটের আবহে জনমোহিনী প্রতিশ্রুতির চেয়ে এই ভারতে ইদানীং আরও বেশি কাজে দিচ্ছে সংখ্যালঘু-বিদ্বেষ!
ঠিক কী রকম এই ঘৃণাভাষণের চরিত্র, তাও বিশ্লেষণ করে দেখেছে গবেষণাটি। ৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে নেতারা ইঙ্গিত বা সরাসরি বলেছেন নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের কথা: লাভ জেহাদ, ল্যান্ড জেহাদ, হালাল জেহাদ এমনকি জনসংখ্যা জেহাদও। ৩৬ শতাংশ ঘটনায় সরাসরি দেওয়া হয়েছে ‘মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ হিংসা’র ঘোষণা, ১৬৯টি ঘৃণাভাষণের ঘটনায় উস্কানি দেওয়া হয়েছে মসজিদ বা মুসলিম প্রার্থনাস্থল ইত্যাদিকে লক্ষ্য করে। এ ছাড়াও আছে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বয়কট করার ডাক, আলাদা করে সংখ্যালঘু মহিলাদের এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণ ইত্যাদি, ‘গদ্দার’ বা বিশ্বাসঘাতক থেকে শুরু করে নির্বাচিত ‘সুভাষিত’র উল্লেখ নাহয় বাদই দেওয়া গেল। রিপোর্টে আলাদা করে দেখানো হয়েছে ঘৃণাভাষণের কান্ডারি ও ভান্ডারি কারা— বিজেপি নেতাদের পাশাপাশি যোগ্য সঙ্গত করেছেন নানা হিন্দু ধর্মনেতা ও গুরু; মোট ঘটনার প্রায় ৪৬ শতাংশ ঘটেছে এমন অনুষ্ঠানমঞ্চ থেকে যাদের আয়োজক সঙ্ঘ পরিবার; বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দলের পাশাপাশি গোরক্ষা দলের ঘৃণাভাষণ প্রবণতার বাড়বাড়ন্তও উঠে এসেছে।
আজকের ভারতের এ সব অজানা নয়। হয়তো তথ্য-পরিসংখ্যানগত এই হিসাব জানা ছিল না, কিন্তু বিজেপি শাসনামলে ঘৃণাভাষণ কোন স্তরে পৌঁছেছে তা বুঝতে ভোটের অপেক্ষা করতে হয় না, সমাজমাধ্যমেই মালুম হয়। শাসক দল নিশ্চয়ই এই পরিসংখ্যান নস্যাৎ করবে— যা কিছুই তাদের দল মত পন্থা ও শাসনকৌশলের বিরোধী তাকেই দেশদ্রোহী, ভারতবিরোধী দেগে অস্বীকার বা বর্জনের অভ্যাস তাদের মজ্জাগত, তদুপরি এ তো আমেরিকার গবেষণা। অচিরেই লোকসভা নির্বাচনের দামামা বাজবে, রামমন্দির প্রতিষ্ঠা আর জ্ঞানবাপী মসজিদের ‘পুনরধিকার’-এর গৌরবভাষ্যে সংখ্যালঘুদের স্থানটি বুঝিয়ে দেওয়ার কাজটিও পূর্ণোদ্যমে শুরু হওয়ার কথা। এবং এ যে শুধু বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই তা নয়, অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতেও হবে, অতীত সাক্ষী। কুকথায় কার্যসিদ্ধির সাফল্যহার বরাবরই বেশি।