OTT Platform

নিজেদের কথা

সরলীকরণের ঝুঁঁকি নিয়ে বলা যেতে পারে, মেয়েরা এখন ‘ওভার দ্য টপ’। চমকপ্রদ বিষয়, হিন্দি ওটিটিতে প্রযোজক এবং পরিচালক হিসাবে উঠে আসছেন বহু দক্ষ পরিচালিকা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৪ ০৮:০১
Share:

একটি শব্দবন্ধ কত বিশেষ অর্থে বিশিষ্ট হয়ে যায়, তার সাম্প্রতিক প্রমাণ: ‘ওভার দ্য টপ’। স্মার্ট টিভির যুগে তা সংক্ষিপ্তাকারে এক অতি বিশেষ এবং জরুরি বস্তুর পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে: ‘ওটিটি’। টিভি চ্যানেলে চটজলদি খবর, সন্ধ্যায় তা নিয়ে চিৎকৃত বৈঠকি বিশ্লেষণের পাশে বিনোদনের জন্য ধারাবাহিক সিরিয়ালদর্শন আজকের নাগরিক জীবনে প্রায় নিত্যকর্ম হয়ে উঠেছে। সঙ্গে সঙ্গে এই দুইয়ের বাইরেও গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ওটিটি চ্যানেলে বুঁদ হয়েছেন শহরে-মফস্‌সলে, উচ্চ-মধ্য-নিম্ন সর্বপ্রকার বিত্তসম্পন্ন গৃহস্থ বাড়ির দর্শক। সেখানে আধ ঘণ্টার পর্বে পর্বে বহু রকম চলচ্ছবি দেখা যায়। এই সিনে-দর্শনে মেগাসিরিয়ালের মতো অন্তহীন দ্রৌপদীর শাড়ি টানাটানি চলে না, সময়সুযোগ বুঝে টিভি বা মোবাইলে চোখ রাখলেই হয়। গণজ্ঞাপন নিয়ে মার্শাল ম্যাকলুহানের মতো তাত্ত্বিক বলেছিলেন, মাধ্যমই বার্তা। হিন্দি, বাংলা নির্বিশেষে সব ওটিটি-র দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, সেই বার্তা আজকাল কত চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে একটি বিশেষ ধারা লক্ষণীয়— দলিত থেকে মধ্যবিত্ত সব স্তরের নারীর সমস্যা এবং তাঁদের নিজস্ব স্বর। অনেক ওটিটি-তেই নারীপ্রধান গল্প, নায়িকার পাশাপাশি কাহিনি ও চিত্রনাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক অনেকেই নারী— যেখানে প্রথাগত সিনেমায় আজও বিরল কিছু দৃষ্টান্ত বাদ দিলে শুধুই নায়ককেন্দ্রিক গল্প।

Advertisement

ফলে কিছু সরলীকরণের ঝুঁঁকি নিয়ে বলা যেতে পারে, মেয়েরা এখন ‘ওভার দ্য টপ’। চমকপ্রদ বিষয়, হিন্দি ওটিটিতে প্রযোজক এবং পরিচালক হিসাবে উঠে আসছেন বহু দক্ষ পরিচালিকা। জ়োয়া আখতার ও রিমা কাগতির কথা মনে করা যেতে পারে দৃষ্টান্তস্বরূপ। এক জন মুম্বইকন্যা, জাভেদ আখতার ও হানি ইরানির সন্তান, অন্য জন অসমের তিনসুকিয়ার মেয়ে। তাঁদের কাহিনি ও পরিচালনায় প্রথম ওটিটি সিরিজ় যে ভাবে দলিত কন্যা ও উচ্চবর্গের হিন্দু যুবকের বৌদ্ধ প্রথায় বিয়ে, সন্তান-সহ ডিভোর্সি মায়ের বিয়ে, কখনও বা দুই সমকামী মহিলার সম্পর্কে সিলমোহর, ভারতীয় বিয়েতে পরিবারগুলির নিজস্ব সংঘাত ও সমঝোতা দেখায়, তার জনপ্রিয়তা একুশ শতকের অসুস্থ সময়েও ভরসা জোগাতে পারে। ইতিহাসবিদ রোচনা মজুমদারের গবেষণা দেখিয়েছিল, ‘অ্যারেঞ্জড ম্যারেজ’ বা অভিভাবকদের নির্ধারিত বিয়ে আদৌ চিরন্তন ঐতিহ্য নয়। তা আসলে বিয়ের বাজার, সংবাদপত্র ইত্যাদি ঔপনিবেশিক আধুনিকতার অবদান। সেই আধুনিকতার বয়ানে যে আজও কত ফাঁকফোকর, দেখিয়ে দেয় এই সব ওটিটি ছবি, অন্য কোনও নতুন অভিমুখে চিন্তা তরঙ্গিত করতে থাকে। এই সব সিরিজ় এখন বিশ্ব জুড়ে বহুদর্শিত, বহুচর্চিত। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে যাওয়া ওটিটি সিরিজ়-এ দেখা গেল রাজস্থানের গ্রামে দলিত কন্যার মারকুটে পুলিশ অফিসার হয়ে ওঠার কথা, যিনি সকলের হাসিঠাট্টার চোটে গোড়ায় নিজের পদবি বদলে নিলেও শেষ দৃশ্যে ফের জন্মগত দলিত পদবিটি বেছে নেন। সিনেমা নয়, আজকের ওটিটি এই ভাবেই মেয়েদের কথা বলে, মূল ধারার সমাজকে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড় লাগাতে চায়।

বাংলা ওটিটি-তেও নারীচেতনার এই নতুন ধারা প্রবাহিত। কোথাও ধর্ষিতা ছাত্রীর মা-বাবা লোকলজ্জায় মেয়েকে লুকিয়ে রাখতে চান, রুখে দাঁড়ান শিক্ষিকা। কোথাও দুঁদে মহিলা আইনজীবী তাঁর শামলা খুলে সাক্ষীর কাঠগড়ায়। মাতাল পুরুষরা যে দিন রাস্তায় এক মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করছিল, তিনিই ছিলেন বিবাহিত প্রেমিকের বাইকে। এত দিন লজ্জায় বলতে পারেননি। আজ সেই লজ্জা ভেঙে স্বীকারোক্তির দিন। কোথাও ছাত্রীর আত্মহত্যার চেষ্টায় অধ্যাপকের স্ত্রী ছাত্রীকে প্রথমে দায়ী করলেও পরে দেখেন তাঁর স্বামীই দায়ী। একক মায়ের সংগ্রাম উঠে আসে। কাজের মেয়ের নিগ্রহের গল্প সজোরে ধাক্কা দিয়ে সজাগ করে তোলে। জানিয়ে দেয়, দাম্পত্য শুধু প্রেম এবং সন্তান পালনের ললিত কাহিনি নয়, পাশেই থাকে সামাজিক ও পারিবারিক গলিত আধিপত্যবাদ। কেবল পরিচালনা ও কাহিনি নয়, অভিনেত্রীদের নৈপুণ্য ও শক্তিও দর্শককে বিস্মিত করে। প্রশ্ন উঠতে পারে, বিনোদন পর্দা ছাড়িয়ে কত দূর যায়, ওটিটি-র মেয়েরা কি দর্শকাসনের মেয়েদের ক্ষমতায়ন এতটুকুও প্রভাবিত করে? বড় জটিল প্রশ্ন। কিন্তু এই নবধারাপাতকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতেই হয়। মেয়েরা নিজেদের গল্প নিজেরাই বলতে চাওয়ার এই গতি সবলতর হোক। কোনও বিশেষ ‘দিবস’ মেনে নয়, প্রতি দিন, প্রতি ঋতুতে— সাহিত্য, সংবাদ, ওটিটি থেকে প্রতিটি মাধ্যমে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement