ফাইল চিত্র।
এক কালে গ্রামীণ রাস্তা বলিতেই মনে ভাসিয়া উঠিত অজস্র খানাখন্দপূর্ণ, স্থানে স্থানে ধসিয়া যাওয়া, এবং বৃষ্টিতে প্রবল কর্দমাক্ত এক সড়কের চিত্র। যানবাহন দূরস্থান, অসুস্থ বা বৃদ্ধ মানুষের পক্ষে সেই রাস্তা পদব্রজে অতিক্রম করাও সুকঠিন ছিল। সেই ছবি এখন বহুলাংশে অতীত। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক প্রকল্পে উন্নয়নে গতি আসিয়াছে, পশ্চিমবঙ্গের বহু প্রত্যন্ত গ্রামের সড়কে পিচের আস্তরণ পড়িয়াছে। কিন্তু তাহার সহিত তাল মিলাইয়া যাহার আগাইবার কথা ছিল, সে পারে নাই। ভুল হইল— আগাইতে তো পারেই নাই, পিছাইয়া পড়িয়াছে। তাহার নাম শহর। প্রতি বার বর্ষা আসিলেই রাজ্যের নানা এলাকার শহরের দুর্দশাগ্রস্ত রাস্তার ছবিগুলি উঠিয়া আসে। এই বার যেমন দুই দিনের বর্ষণেই কলিকাতার রাস্তার কঙ্কালসার হালটি দেখা যাইতেছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, দমদম রোড, ধর্মতলা বাসস্ট্যান্ড, ই এম বাইপাস, বেহালা— উত্তর, দক্ষিণ বা পূর্ব, ভাঙাচোরা সড়কের ভাগ কোথাও কম পড়ে নাই। কলিকাতা-লাগোয়া হাওড়া শহরেও চিত্রটি প্রায় অভিন্ন। জমা জল সরিতেই কোথাও রাস্তায় ধস নামিয়াছে, কোথাও পিচের আবরণ চটিয়া গিয়াছে। জি টি রোডের ন্যায় প্রধান সড়কে এক-দেড় ফুট অবধি গর্তের সৃষ্টি হইয়াছে। ব্যতিক্রম হয় নাই অপরাপর ছোট জেলার শহরগুলিও। নদিয়ার নাকাশিপাড়ায় ভারী বৃষ্টির পর হইতে প্রাণ হাতে করিয়া যাতায়াতের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করিয়াছেন নিত্যযাত্রীরা। অতএব, ‘গ্রামের রাস্তা’ বলিয়া হেলা করিবার দিন গিয়াছে। বরং সমাজ, প্রশাসন ও রাজনীতির কারবারিরা এক সঙ্গে মিলিয়া কী ভাবে সার্বিক উন্নয়নে উদ্যোগী হওয়া যায়, সেই মডেলটি বেলপাহাড়ি বা গরুমারার কোনও প্রত্যন্ত গ্রাম হইতে মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করিলে শহর কিছু শিখিতে পারে।
শিখিবার পথটি, যদিও, বহু বাধায় কণ্টকিত। প্রতি বার বর্ষা পার হইতেই শহরের অনেক রাস্তা মেরামতির মুখ দেখিয়া থাকে। প্রশ্ন হইল, একটি সড়ক যথাযথ ভাবে মেরামত করিলে কী উপায়ে তাহা বৎসরান্তে বেহাল হইয়া যায়? দুর্জনে বলিবে, সরকার কর্তৃক সড়ক খাতে বরাদ্দ অর্থের পুরা অংশটি ঠিকাদার কর্তৃক যথার্থ ভাবে ব্যয়িত হয় না। ফি বৎসর ইট-বালি-সিমেন্ট ক্রয় করিবার আবর্তে লাভের গুড় আছে, পিপীলিকারও অভাব নাই। তবে দুর্দশার একটি দিক যেমন সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের দুষ্টচক্র, অপর দিকে আছে প্রশাসনের গয়ংগচ্ছ ভাব। হাওড়ার বহু রাস্তায় গত পাঁচ বৎসর মেরামতির কাজ হয় নাই। ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠিতেই পারে, তাহার বহুলাংশে হয়তো অসত্য কিছু নাই, কিন্তু উদ্যোগটিই শুরু করিতে না পারিবার সম্পূর্ণ দায় প্রশাসনকে লইতে হইবে। আর, রাজনৈতিক বাহু ও অর্থবলের সহিত ঠিকাদারদের যোগসাজশ ও আপস রফার পাটিগণিতের ফলে নাগরিক পরিষেবা ব্যাহত হইবার দায়ও স্থানীয় প্রশাসন ঝাড়িয়া ফেলিতে পারে কি? পাশাপাশি শুশ্রূষার বন্দোবস্ত করা তাই আশু কর্তব্য। প্রশাসনিক গড়িমসি সরাইয়া, দুর্নীতির মোকাবিলা করিয়া, অপরাপর লাল ফিতার ফাঁস কাটাইয়া, সর্বোপরি রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলিয়া সড়ক সারাইবার দিকে মনোনিবেশ করিতে হইবে। এই যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইবার আর কোনও পথ নাই।