ফাইল চিত্র।
জার্মানিতে আয়োজিত জি-৭ বৈঠকে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সওয়াল শুনলে সংশয় হওয়া স্বাভাবিক, বিদেশের আলোহাওয়ায় নিশ্চয়ই ম্যাজিক আছে। না হলে, যাঁর আমলে দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি রয়েছে, সরকারের সমালোচক বা স্বাধীনচেতা সাংবাদিকমাত্রেরই হেনস্থা হওয়া প্রায় স্বাভাবিকতায় পর্যবসিত হয়েছে, দেশের সীমানা পেরোলেই তিনি বাক্স্বাধীনতার এমন প্রবল প্রবক্তা হয়ে ওঠেন কোন মহামন্ত্রে? তবে, তাঁর বচনামৃতের অন্তঃসারশূন্যতা এই দফায় দুনিয়ার হাটে বড় বেশি প্রকট হয়ে গেল। আল্পস-এর সানুদেশে তিনি যখন বাগ্বিস্তার করছেন, তার দু’দিন আগে গ্রেফতার হয়েছেন তিস্তা শেতলবাদ; এবং কয়েক ঘণ্টা আগে সাংবাদিক মহম্মদ জ়ুবেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছে পুলিশ— চার বছর আগে একটি টুইট করার অপরাধে। ‘ডিসটোপিয়া’ শব্দটি ভারতে তার অভিঘাত হারিয়েছে— এই দেশ তার প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত যাপন করে সেই ভয়াবহতায়। কিন্তু, এই বাস্তবে দাঁড়িয়েও, মহম্মদ জ়ুবেরের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাকে পৃথক গুরুত্ব দেওয়া বিধেয়। তিনি স্ট্যান স্বামী বা ভারাভারা রাও নন; গৌতম নওলখা, কোবাড ঘান্দী বা তিস্তা শেতলবাদ নন; এমনকি তিনি কাপ্পান সিদ্দিকিও নন। সবার মতোই তিনিও শাসকের আধিপত্যকামিতার বিরোধী, উগ্র গৈরিক জাতীয়তাবাদের বিরোধী। কিন্তু, তাঁর বিরোধের প্রক্রিয়ার সঙ্গে অন্যদের বিরোধিতার একটি মূলগত ফারাক রয়েছে। মহম্মদ জ়ুবেরের বিরোধিতা আক্ষরিক অর্থেই অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের প্রাত্যহিক যুদ্ধ। ২০১৭ সাল থেকে তিনি নিরন্তর ভুয়ো তথ্য যাচাই করে চলেছেন। সেই সাংবাদিকতাই তাঁর পেশা।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভারতে গৈরিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে, উগ্র ও সঙ্কীর্ণ দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে যাঁরাই লড়ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেরই লড়াই এক বৃহৎ অসত্যের বিরুদ্ধে। যে কল্পনাটি নাগপুর প্রকৃত ‘ভারত’ বলে চালাতে চায়, সেটি অসত্য— ভারত নামক দেশটি কখনও এমন একশৈলিক, অনুদার, অসহিষ্ণু ছিল না। কিন্তু, সেই বৃহৎ অসত্যের পাশাপাশি— সেই অসত্যকে প্রতিষ্ঠা করতেই— ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে দেওয়া হয় ছোট-বড় অজস্র মিথ্যার বিষ, যার প্রতিটিরই অভীষ্ট ভারতের বহুত্বকে আক্রমণ করা, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার মাত্রা বৃদ্ধি। সহযোগী কয়েক জন সাংবাদিকের মতো মহম্মদ জ়ুবেরের যুদ্ধ ছিল এই ফেক নিউজ় বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়ানো মিথ্যা খবরের বিরুদ্ধে। প্রতিটি ‘খবর’-কে যাচাই করে তাঁরা জানাতেন, তার কোন ভাঁজে অসত্য লুকিয়ে আছে, কোথায় ক্ষীণ সত্যের মুখোশ পরে আছে ভয়ানক মিথ্যা। আইটি সেলের মিথ্যাচারের পথে তাঁরা যথাসাধ্য বাধা সৃষ্টি করেন। আজকের হাতে হাতে ইন্টারনেটের যুগে গণতন্ত্রের কাছে অসত্যের বিরুদ্ধে এই প্রাত্যহিক যুদ্ধের মূল্য অপরিসীম।
সন্দেহ হয়, জ়ুবেরকে গ্রেফতার করার প্রাথমিক কারণ শাসকদের প্রতিশোধস্পৃহা। জ়ুবেরই প্রথম বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মার মন্তব্যটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই কারণে বিশ্বমঞ্চে নরেন্দ্র মোদী সরকারকে বিপুল নিন্দা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজে। জ়ুবেরের উপর সরকারপক্ষের রাগ থাকা স্বাভাবিক। তবে আসল রাগ সম্ভবত রাজনৈতিক মিথ্যার বিরুদ্ধে জ়ুবেরের প্রাত্যহিক জেহাদের কারণে। এবং, সে জন্যই তাঁর গ্রেফতার হওয়ার ঘটনাটি গণতন্ত্রের পক্ষে মারাত্মক। শুধুমাত্র সত্যের পক্ষে থাকার জন্যই যদি রাষ্ট্রক্ষমতা কোনও নাগরিককে কঠোর ভাবে দমন করতে চায়, তাতে একনায়কতন্ত্রের পদধ্বনি অতি প্রকট। এবং, চার বছরের পুরনো টুইটের কারণ দর্শিয়ে গ্রেফতার করার মধ্যে রয়েছে স্পষ্ট ঔদ্ধত্য— চক্ষুলজ্জাটুকুও না থাকার কথা ঘোষণা করে দেওয়া। একনায়কতন্ত্র এ ভাবেই নিজের অস্তিত্বের কথা ঘোষণা করে।