ফাইল চিত্র।
নামে যে কত কিছুই আসে যায়— গত কয়েক দিনে পশ্চিমবঙ্গে জেলাভাগ ও জেলা নামকরণের অভিঘাতে তা আরও এক বার সামনে এল। কোনও জায়গার নতুন নামকরণে কি প্রশাসনিক প্রয়োজনই প্রধান বিষয় হওয়া উচিত, না কি নামের সঙ্গে জড়ানো সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকাও একই রকম জরুরি— এই মুহূর্তের পশ্চিমবঙ্গে এই প্রশ্নটি তাত্ত্বিক কিংবা তার্কিক ক্ষেত্র ছেড়ে সোজা নেমে এসেছে রাস্তার মিটিং-মিছিলে। গত মঙ্গলবার শান্তিপুরে প্রতিবাদ মিছিল দেখা গেল, যার দাবি— মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের গৌরবলগ্ন পরিচয় যে নদিয়া নামটিতে, অতিসম্প্রতি ঘোষিত নতুন জেলা কিছুতেই তা বাদ দিয়ে চলতে পারে না, অথচ তার নাম দেওয়া হয়েছে রানাঘাট। সাধারণ নাগরিক যাঁদের অনেকেই তেমন কোনও রাজনৈতিক কাজেকর্মে জড়িত থাকেন না, দেখা গেল তাঁরাও এই মিছিলে যোগ দিলেন। পশ্চিমবঙ্গের জেলা সংখ্যা ২৩ থেকে ৩০-এ বাড়ানো, এবং নতুন জেলার নামকরণের ঘোষণা এই ভাবেই বহু রাজ্যবাসীর সংবেদনে আঘাত করছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কি আগে এই সম্ভাবনা ভেবে দেখেনি? আগে কি মনে হয়নি যে, এক জন-দু’জন সিদ্ধান্ত না নিয়ে সামাজিক স্তরে আলাপ-আলোচনা চালালে গ্রহণযোগ্যতাও বাড়তে পারে, পরিকল্পনার কাজেও সাহায্য হতে পারে? না কি মনে হয়েছে, সংবেদন মানে কেবল দু’দিনের লেখালিখি বলাবলি, তাই সাতপাঁচ ভাবনা না বাড়িয়ে সিদ্ধান্ত কার্যকর করে দিলেই ব্যাপারটি চুকে যায়?
বিস্ময়ের কিছু নেই, এই হাতুড়িসদৃশ প্রশাসনিক পদ্ধতি এখন সর্বত্র দৃশ্যমান, কেন্দ্রেও, রাজ্যেও। আলাপ-আলোচনা বস্তুটির প্রয়োজন এ দেশে ফুরিয়েছে, ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘোষণাই এখন সর্বজনমান্য পথ। তবে কিনা, ঢাকঢোলের আতিশয্য এ ক্ষেত্রে আরও একটি সন্দেহের জন্ম দেয়। ঠিক কী ও কতখানি পরিবর্তন আনতে চলেছে এই সংস্কার? আগের থেকে কোন সুবিধে বেশি হতে চলেছে? জেলার আকার ও জনসংখ্যার আধিক্যই কি জেলার সমস্যার প্রধান কারণ ছিল? আকার ছোট হলে এবং জেলার জনসংখ্যা কমলেই সেগুলি দূর হবে? বহু-অভিজ্ঞতাসিঞ্চিত পাপীমন অন্য কথা বলে। বলে যে, সমস্যার সমাধান আগেও সম্ভব ছিল, কেবল সমাধানের চেষ্টায় ছিল ঘাটতি। দীর্ঘকালীন ও ক্রমান্বিত সেই ঘাটতিকে আবৃত করে রাখার জন্যই ঢাকঢোলের দরকার এতখানি অনুভূত হচ্ছে। যে কাজ ক্রমে ক্রমে নিয়মানুসারে করার কথা, তাকে এক ধাক্কায় সেরে রাজনৈতিক চমক তৈরি করতেই এই আকস্মিক হইচই-এর অবতারণা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত স্মরণীয়, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটিতে জেলার সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম, জেলাপ্রতি জনসংখ্যাও সর্বাধিক। ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, জেলাপিছু গড় জনসংখ্যা সারা দেশে যখন ১৬ লক্ষ, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে তা ৪০ লক্ষ। অবশ্য এই বৈষম্যের একটি কারণ এ রাজ্যের স্বাভাবিক জনসংখ্যার অধিক ঘনত্ব। এবং সেই কারণেই জেলা ভেঙে অধিকসংখ্যক হলেও জনঘনত্বের আপেক্ষিক ছবিটি বিশেষ পাল্টানোর সম্ভাবনা নেই। ৩০টি জেলাতে যদি গত দশ বছরের জনবিন্যাসের পরিবর্তন ধরে হিসাব করা হয়, তা হলেও বোঝা যাবে, বাস্তব চিত্র খুব সামান্যই পাল্টাতে চলেছে। জেলাপ্রতি জনসংখ্যার দিক দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পরেই মহারাষ্ট্র: ৩১ লক্ষ। এই তথ্যাণুটিও বলে দেয়, প্রশাসনের গুণমানের সঙ্গে জনঘনত্ব ও জেলাসংখ্যার সরল সম্পর্কের আশা নেহাতই ছেলেমানুষি। শর্টকাট দিয়ে মহৎ কার্য সিদ্ধ হয় না। সলতে পাকানো ও আলো জ্বলার মধ্যে যেটুকু কার্যকারণ সম্পর্ক, জেলাসংখ্যা বাড়ানো আর প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়ানোর মধ্যে সেটুকু দেখানোও কঠিন। অতঃপর আসল কাজগুলি গুরুত্ব দিয়ে করা হোক। আলো এলেও আসতে পারে।