বাংলাদেশের ‘অস্থির’ পরিস্থিতিতে এমনিতেই উদ্বিগ্ন দিল্লি। এর মাঝে বেজিং-এর সঙ্গে আরও এক পড়শি রাষ্ট্রের হৃদ্যতা চিন্তা বাড়াচ্ছে সাউথ ব্লকের। চিন্তার কারণ, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি-র সাম্প্রতিক চিন সফর। ওলি-র সফরকালে চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প-সহ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা এবং বিবিধ উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়ে আরও অন্তত দশটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে দু’দেশের মধ্যে। বিআরআই-কেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন ওলি। ২০১৭ সালেই প্রকল্পটি নিয়ে প্রাথমিক চুক্তি হয়েছিল চিন ও নেপালের। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার রূপরেখা নির্ধারিত না হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক জটিলতায় শেষ পর্যন্ত শুরু করা যায়নি কোনও কাজ। তবে সাম্প্রতিক সফরে প্রকল্পের যাবতীয় জট কাটার বিষয়ে চিনের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে বলেই দাবি করেছেন ওলি।
বিআরআই নিছক কয়েকটি পরিকাঠামোগত প্রকল্পের সমষ্টি নয়, এটি চিনের বৈদেশিক নীতি এবং বিশ্বব্যাপী উচ্চাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিপ্রস্তরও বটে। অন্য দিকে, চিনের এই আন্তর্জাতিক প্রকল্পে নেপালের অন্তর্ভুক্তি পাহাড়ি রাষ্ট্রটির বৈদেশিক নীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। এ-যাবৎ দিল্লির সঙ্গে সৌর্হাদপূর্ণ সম্পর্কই বজায় রেখে এসেছে কাঠমান্ডু। দেশের শীর্ষপদে নির্বাচিত হওয়ার পরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে প্রথম বৈদেশিক সফরে সে রাষ্ট্রের নেতারা দিল্লিতেই এসেছেন এত কাল। কিন্তু সেই প্রথা ভেঙে ওলি-র চিন সফর শুধু সে দেশের কূটনৈতিক সমীকরণই নয়, আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির গতিপ্রকৃতি বদলের সম্ভাবনাকে আরও স্পষ্ট করে দিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, নেপাল দিল্লি-নির্ভরতা কমিয়ে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিস্তৃত করে আরও নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধার অন্বেষণে আগ্রহী। শুধু তা-ই নয়, দিল্লির বিরুদ্ধে কাঠমান্ডুর অন্যতম অভিযোগ ছিল সে দেশের সংযোগ এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলির উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভারতের থেকে যথাযথ সাহায্য না মেলার। চিনের প্রকল্পটি তাদের জন্য উন্নত পরিকাঠামো এবং শক্তি সুরক্ষার সুযোগ এনে দেবে। তবে, প্রশ্নও আছে। এর আগে বহু ক্ষুদ্র দেশ বিআরআই-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত চিনের ঋণজালে জড়িয়ে পড়েছে। প্রায় এক শতকের জন্য শ্রীলঙ্কার বেজিংকে তাদের হাম্বানটোটা বন্দরের ইজারা প্রদান যার অন্যতম উদাহরণ। চিনের অর্থে বহুলাংশে নির্মিত নেপালের পোখরা বিমানবন্দরের ব্যর্থতাও কাঠমান্ডুকে ক্রমশ সেই পথেই ঠেলে দিচ্ছে। সংশয় নেপালের জোট সরকারের অন্দরেও— আদৌ কি সব দিক বিবেচনা করে চিনের প্রকল্পে যোগ দিচ্ছেন ওলি?
ভারতের আশঙ্কা— পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো এ বার নেপালকেও ঋণের জালে জড়িয়ে করায়ত্ত করতে চাইছে বেজিং। একই সঙ্গে পাহাড়ি রাষ্ট্রটির দেশীয় রাজনীতিতে আগামী দিনে প্রভাব বৃদ্ধির পথে এগোবে তারা। বস্তুত, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিকে ঋণের ফাঁদে ফেলে আপসের পথে আসতে বাধ্য করে পরোক্ষে দিল্লির উপরেই চাপ বৃদ্ধি করতে চাইছে বেজিং। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের অবস্থান রক্ষার্থে নেপাল-সহ পড়শি রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে ভূরাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে ফের ভাবতে হবে দিল্লিকে।