ফাইল চিত্র।
দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন শাসক দলের ইতিহাস পুনর্লিখন নিয়ে ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব সম্প্রতি যা বললেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা শুনেছেন কি? ইতিহাসে তথ্যের সঙ্গে কোনও আপস করা চলে না, ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তা বলে ইচ্ছামতো কোনও ঘটনাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়া যায় না: আকবর মোগল ‘বাদশা’ বলে, রাজপুত ‘রাজা’ নয় বলে তাঁর ঔদার্য অস্বীকার করা, বা ভারতে জাতপাতের ইতিহাসের সূচনাভূমি হিসেবে মুসলিম রাজত্বকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া চলে না। অমিত শাহের কাছে এই সবই নিরর্থক একপেশে মনে হবে, কিংবা ‘ভারতবিরোধী’, কারণ তাঁর দল ও সরকার একটি নির্দিষ্ট মতে পথে ও রঙে গোটা দেশকে ভোলাতে চাইছেন— বহুত্বের ইতিহাস মুছে একরঙা হিন্দু জাতীয়তাবাদের ইতিহাস তা। এই জন্যই খোদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখা যায় রাজপুত ইতিহাসবই উদ্বোধনে, ভারতের অধিকাংশ ইতিহাসবিদ পাণ্ড্য চোল মৌর্য গুপ্ত অহোম সাম্রাজ্যগুলি উপেক্ষা করে স্রেফ মোগল ইতিহাস লেখাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন— এমন অভিযোগে মুখর হন তিনি। বুঝতে অসুবিধা হয় না, যাঁর আপত্তির শিকড় ইতিহাসবিদদের মুসলিম তথা অ-হিন্দু ইতিহাসের মান্যতায়, সুলতানি ও মোগল শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ‘রাজা’দের প্রতিরোধ তো তাঁর ভাষায় ‘সংস্কৃতি, ভাষা ও ধর্ম রক্ষার যুদ্ধ’ হয়ে উঠবেই।
বিজেপির আমলে ভারতের হিন্দু ইতিহাসের ‘হঠাৎ’ বাড়বাড়ন্ত যে এ নয়, তা বোঝার সময় এসেছে। এ এক সুপরিকল্পিত সুকৌশলী ‘অ্যাজেন্ডা’, কেন্দ্রীয় সরকার যা জনমনে চারিয়ে দিতে চাইছে। ইতিহাস মানেই হিন্দু ইতিহাস, ভারতগর্ব মানেই হিন্দু অস্মিতা, এই তত্ত্বের প্রায়োগিক রূপ দেখা যাচ্ছে সর্ব স্তরে: জাতীয় শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে ইতিহাস পুনর্লিখনের উদ্যোগে, চলচ্চিত্রে হিন্দু মিথ-আখ্যান-কিংবদন্তিকে ঐতিহাসিক বাস্তব রূপে, কিংবা শিবাজি বা পৃথ্বীরাজের কাহিনিকে নিজেদের তত্ত্বের সমর্থনে হিন্দুত্বের মোচড়ে মোড়কে পরিবেশন করার প্রয়াসে, এবং সর্বোপরি নেতা মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক থেকে কর্মী সমর্থকদের প্রকাশ্য হিন্দুবাদী তর্জন গর্জনে— সমাজমাধ্যমে মুসলিম-বিদ্বেষের ভরা কটাল নাহয় ছেড়েই দেওয়া গেল। “আমাদের সত্য লেখা থেকে কেউ আটকাতে পারবে না, আমরা আমাদের ইতিহাস নিজেদের মতো করে লিখব,” অমিত শাহের এই সাম্প্রতিক নির্ঘোষকে সত্যলিখনের প্রতি দায়বদ্ধতা ভাবলে মূর্খামি হবে, তাকে পড়তে হবে ক্ষমতার উদ্ধত আস্ফালন হিসেবে। আর এখানেই ইতিহাসের সমূহ ক্ষতির ঝুঁকি। রাজনীতির হাতে যদি দেশের ইতিহাস লেখার কাজটি ন্যস্ত হয়, তা হলে যা লেখা হবে তা ইতিহাস নয়, ক্ষমতার একপেশে বয়ান, দল ও সরকারের স্বার্থসেবী খণ্ডসত্য। ভারতের নাগরিককে বুঝতে হবে ইতিহাস শুধু রাজা-বাদশা শাসকের জমানা বর্ণনার ফিরিস্তি নয়, ইতিহাস সাধারণ মানুষেরও; তা ব্যক্তি ও সমাজের সমষ্টিস্মৃতি। তাতে অপ্রিয় সত্য মিশে থাকলেও তা সত্য, তাকে অস্বীকার করলে বা বই থেকে মুছে ফেললেই সে সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে না। জার্মান শিশু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস মন দিয়েই পড়ে, সে দেশের সরকার বই থেকে তা মোছেনি। ভারতের শাসকের হাতে নাগরিকেরা দেশের ইতিহাস লেখার জরুরি কলমটি তুলে দিলে তা হবে আক্ষরিক ও সর্ব অর্থে এক ‘ঐতিহাসিক’ ভুল।