কেন্দ্রীয় সরকার সব দোষই জওহরলাল নেহরুর ঘাড়ে চাপায়, বললে অত্যন্ত অন্যায় হবে। গত দু’বছর ধরে আর্থিক বৃদ্ধির শ্রীহীনতার দায় চাপাচ্ছে কোভিড অতিমারির উপর; এখন মূল্যস্ফীতির দায় চাপাচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অথবা আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোলিয়ামের বর্ধিত দামের উপর। যা-ই ঘটুক না কেন, সরকারের কোনও দায় নেই— সবার উপরে এটুকুই সত্য। পরিসংখ্যান ভিন্ন কথা বলতে চাইলে, দোষের দায়ভার সরকারের কাঁধে চাপাতে চাইলে, সেই পরিসংখ্যানকে আঁতুড়ে মেরে দেওয়াই ইদানীং কালের দস্তুর। তবুও, মথুরার কারাগারের লৌহনিগড় সাক্ষ্য দেবে, শত চেষ্টাতেও শেষ রক্ষা হয় না। সম্প্রতি যেমন দুটো বিপজ্জনক হিসাব জনসমক্ষে চলে এল। প্রথমটি জানাল, অতিমারি শুরু হওয়ার আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ধরাশায়ী হয়েছিল; দ্বিতীয় তথ্যটি বলল, দেশে অভ্যন্তরীণ মূল্যবৃদ্ধির পিছনে আন্তর্জাতিক কারণের দায় সামান্যই। অর্থাৎ, সাম্প্রতিক কালের দু’টি সর্ববৃহৎ ব্যর্থতার তর্জনী নির্দেশ করছে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকেই। অতিমারির আঁচ অর্থব্যবস্থার গায়ে লেগেছে, সে কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, কারণও নেই— গোটা দুনিয়াই সেই আঁচে ঝলসে গিয়েছে যখন, ভারতই বা ব্যতিক্রম হবে কী ভাবে? কিন্তু, অতিমারি যদি না-ও ঘটত, ভারতীয় অর্থব্যবস্থার গতিভঙ্গ ঠেকানোর উপায় ছিল না। নোট বাতিল এবং যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা ছাড়াই জিএসটি ব্যবস্থা চালু করা— ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৭ সালের জুলাই, এই পৌনে এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকার অর্থব্যবস্থার কোমর ভেঙে দিয়েছিল। অতিমারি আরম্ভ হওয়ার আগেই গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ কমার খবর মিলেছিল, বাজারে চাহিদার অভাব প্রকট হয়েছিল। অতিমারির ধাক্কা লাগার আগেই বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে আরম্ভ করেছিল। প্রতিটিই নির্ভুল লক্ষণ ছিল যে, ভারতীয় অর্থব্যবস্থা জোরালো ধাক্কা খেতে চলেছে। মোক্ষম সময়ে অতিমারি ঘটল, ফলে দোষ চাপানোর জন্য নরেন্দ্র মোদীকে আর নেহরুর কাঁধটি খুঁজতে হয়নি। অতিমারিই সেই দায় নিয়েছিল।
বর্তমান মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে অঙ্কটি এমন খালি চোখে ধরা পড়ার নয়। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিশ্লেষণে সেই সূক্ষ্ম হিসাবটি উঠে এসেছে। জানা গিয়েছে যে, গ্লোবাল কমোডিটি প্রাইস, বা আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্যের স্তরে এক শতাংশ পরিবর্তন হলে ভারতের ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকে পরিবর্তন হয় মাত্র ০.০২ শতাংশ। অন্য দিকে, দেশের পাইকারি মূল্যসূচকে এক শতাংশ বৃদ্ধি ঘটলে ভোগ্যপণ্যের সূচক বাড়ে ০.২৬ শতাংশ। ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচক (কনজ়িউমার্স প্রাইস ইনডেক্স বা সিপিআই) এবং পাইকারি মূল্যসূচক (হোলসেল প্রাইস ইনডেক্স বা ডব্লিউপিআই)-এর মধ্যে একটি চরিত্রগত ফারাকের কথা মাথায় রাখলে এই পরিস্থিতিটির তাৎপর্য অনুধাবন করা সহজ হবে— ভোগ্যপণ্য সূচকে প্রধান গুরুত্ব খাদ্যপণ্য ও পানীয়ের; পাইকারি সূচকে অনেক বেশি গুরুত্ব পায় শিল্পজাত দ্রব্য। এখন, পাইকারি মূল্যসূচক যদি ভোগ্যপণ্য সূচককে এতখানি প্রভাবিত করে, তা হলে স্পষ্টতই, দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিশেষত শিল্পজাত দ্রব্যের মূল্যস্ফীতির প্রভাব ভোগ্যপণ্য সূচকের উপর পড়বে, খাদ্যদ্রব্য মহার্ঘতর হবে। এবং, কোর ইনফ্লেশনের প্রভাব খানিক দেরিতে পড়ে, পরিভাষায় যাকে বলে ল্যাগ— ফলে, খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির প্রবণতাটি আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই আশঙ্কা। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ বা আন্তর্জাতিক তেলের বাজারের উপর এই মূল্যস্ফীতির দায়টি চাপিয়ে দিলে সরকারের আর কিছু করার থাকে না। কিন্তু, এই মূল্যস্ফীতি নিখাদ ‘স্বদেশি’, ফলে দায় সরকারকে নিতেই হবে। অবশ্য, মূল্যস্ফীতি পরিমাপের এই পদ্ধতিটিই গোলমেলে, এবং তার জন্য নেহরুই দায়ী, এমন একটি ভাষ্য তৈরি করে ফেলতে পারলে আর পরিশ্রম নেই। বাকিটা আইটি সেল বুঝে নেবে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।