উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসাবে আমেরিকার আকর্ষণ কি ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কাছে কমছে? পড়াশোনা করতে যেতে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি বা বৃত্তির সুযোগের পরেই আর যে মহা গুরুত্বপূর্ণ অনুমোদনটি প্রয়োজন, সেই ‘স্টুডেন্ট ভিসা’র জন্য ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের আবেদনের হার উল্লেখযোগ্য ভাবে কমেছে এ বছর। আমেরিকারই সরকারি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, এ বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে পরিমাণ ভারতীয় পড়ুয়াকে স্টুডেন্ট ভিসা দেওয়া হয়েছে, আগের বছরের তুলনায় তার সংখ্যা ৩৮ শতাংশ কম, এমনকি কোভিড-আবহে ২০২১ ও ২০২২ এই দুই বছরেও এর চেয়ে বেশি স্টুডেন্ট ভিসা মঞ্জুর হয়েছিল। মে, জুন ও জুলাই এই তিন মাস সাধারণত ভিসা আবেদনের ভরা মরসুম, দেখা যাচ্ছে, এই সময়েও ২০ হাজার ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট স্লট থেকে গিয়েছে অব্যবহৃত। পাশাপাশি এও মনে রাখার, আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিদেশি পড়ুয়া যায় চিন ও ভারত থেকেই, ২০২৩-২৪’এ চিনাদের ডিঙিয়ে ভারতীয় ছাত্ররা সংখ্যার গুরুত্বে প্রথম স্থানটি অধিকার করেছিল।
নতুন বছরে কি তা হলে ধরে নিতে হবে, উচ্চশিক্ষার চাহিদা ও তদনুযায়ী গন্তব্যেরও গুরুত্ব পাল্টাচ্ছে? তারই ছায়া পড়ছে ভিসার আবেদন-চিত্রে? উচ্চশিক্ষার বৈশ্বিক গতিপ্রকৃতি বিশারদরা বলছেন, এর পিছনে আছে নানা কারণ। কোন বিষয়ের জন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় ভাল, আগে সে বিষয়টিই প্রধান গুরুত্ব পেত প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে, পাশাপাশি পড়ার খরচ, বৃত্তি, উচ্চতর গবেষণা, কাজের সুযোগ ইত্যাদিও। কিন্তু এখন খেয়াল রাখতে হচ্ছে রাজনীতি ও বিশেষ করে ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপটও, বিশেষ করে বড় ভূমিকা নিচ্ছে ভারতের সঙ্গে গন্তব্য দেশটির কূটনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্কও। নতুন বছরে হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয় বারের জন্য ফিরছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, অভিবাসন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য, চাকরি ও উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত নীতিতেও কী এবং কেমন বদল আসবে, সেই বিষয়গুলিও মাথায় রাখতে হচ্ছে ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের। অন্য দিকে বলা হচ্ছে, এ বছর আমেরিকার স্টুডেন্ট ভিসায় আবেদনের হার হ্রাসকে তত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই, এ নিতান্তই ‘ভিসা প্রসেসিং’ প্রক্রিয়ায় জটিলতার জের। বড় দেশে ভিসা-সাক্ষাৎকারের সুযোগ আসতে সময় লাগে বেশি, ছাত্রছাত্রীদের হাতে সেই ‘অপেক্ষা’র সময়টুকু না থাকলে এ-হেন সমস্যা হবেই।
তবে একমাত্র আমেরিকা যে এখন আর প্রার্থিত গন্তব্য নয়, এ কথাও সত্য। ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলির চাহিদাও কম ছিল না কখনও, ইদানীং পূর্ব ইউরোপ ও এমনকি এশিয়ারই নানা দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি জমাচ্ছেন ভারতীয় ছাত্রছাত্রীরা— সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এমনকি চিনের স্টুডেন্ট ভিসার চাহিদাও বাড়ছে। কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা ও কাজের সম্ভাবনা যেখানে ভাল ও বেশি, তারই চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে; একটি-দু’টি দেশের প্রতি ঝুঁকে থাকার প্রবণতা ক্ষীণ হচ্ছে ক্রমে। নতুন প্রজন্মের ভারতীয় ছাত্রকুল খুঁজে দেখছেন, কোন দেশের উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ রাখছে, পরধর্ম বা ভিনদেশি সংস্কৃতির প্রতি কারা সমানুভূতিশীল। যে দেশই এই পরীক্ষায় সগৌরবে পাশ করবে, সেখানেই যেতে বাধা নেই— তা হোক ঘরের কাছে বা বহু দূরে, অন্য মহাদেশে। বিশ্বায়ন-উত্তর বিশ্বে উচ্চশিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশের শর্তগুলি পাল্টে যাচ্ছে এ ভাবেই।