ছবি পিটিআই।
হরিদ্বারের এক বারো বৎসরের স্কুলছাত্রী পরিবেশের ক্ষতি সংক্রান্ত যে প্রশ্নটি তুলিতে পারে, তাহা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের ভাবনায় আসে না। আশ্চর্য বইকি! এই দুর্ভাগা দেশে সরকার ভাবে না, গায়ের জোরে ‘উন্নয়ন’ করিবার পরিণামে যে অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় আসে, সেই ক্ষতি পূরণ করিবে কে? বরং এক পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং পরিশেষে দুর্গতদের ক্ষতিপূরণের সরকারি ঘোষণা— ইহাই নিয়ম হইয়াছে। উত্তরাখণ্ডের সাম্প্রতিক বিপর্যয় অন্তত সেই সাক্ষ্যই দিতেছে। এই বিপর্যয় আপাতদৃষ্টিতে প্রাকৃতিক। ভূকম্পে হিমবাহ গলা জলের স্বাভাবিক প্রবাহ রুদ্ধ হইয়াছিল। অতঃপর বিপুল জলরাশি প্রবল বেগে নীচে নামিয়া আসিয়াছে, ‘দেবভূমি’ তছনছ করিয়াছে।
কিন্তু ইহা বৈজ্ঞানিক যুক্তি। আর মানুষের অ-বৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের দায়, যাহা উত্তরাখণ্ডের বিভিন্ন প্রান্তে নিরন্তর ঘটিয়া চলিতেছে? বিপর্যয়ের পশ্চাতে সেই দায় কিছুমাত্র কম নহে, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তাহা প্রাকৃতিক কারণগুলিকে উস্কাইয়া দেয়। পাহাড়ি নদীর জলস্রোত আটকাইয়া বাঁধ নির্মিত হইতেছে, জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়িয়া উঠিতেছে, নদীর দুই তীরের প্লাবনভূমিতে অবৈজ্ঞানিক ভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে জনপদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালে কেদারনাথের ভয়াবহ বন্যার কথা মনে পড়িয়া যায়। সাড়ে পাঁচ হাজার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করিবার পর উন্নয়নের নামে পরিবেশের এই ধ্বংসযজ্ঞের প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হইয়াছিল। পরিবেশবিদরা সতর্ক করিয়াছিলেন, সংবেদনশীল অঞ্চলে পাহাড়ের ভূ-প্রাকৃতিক ভারসাম্য এইরূপে ক্রমাগত বিঘ্নিত হইতে থাকিলে বিপর্যয় আবারও আসিবে। সেই সাবধানবাণীতে কর্ণপাত করা হয় নাই। কেদারনাথ পুনরায় তীর্থক্ষেত্র হিসাবে সাজিয়া উঠিয়াছে; ইট, কংক্রিটে ভরিয়াছে সমগ্র অঞ্চল। শুধুমাত্র বৃষ্টি, বন্যা, হিমবাহের উপর নজরদারি কিছু পরিমাণে বাড়িয়াছে। পরিবেশ সচেতনতা বলিতে এইটুকুই। ভারতের অন্যত্রও চিত্রটি প্রায় এক। পশ্চিমবঙ্গেও উন্নয়নের নামে বনভূমি ক্রমশ উধাও হইতেছে। ঘন অরণ্য উচ্ছেদ করিয়া কোথাও রাস্তা চওড়া হইতেছে, কোথাও পর্যটনকেন্দ্র ও সংলগ্ন জনপদ গড়িয়া উঠিতেছে, কোথাও আবার জঙ্গল চিরিয়া রেলপথ বিস্তৃত হইয়াছে। পাহাড়ের মাটিকে ধরিয়া রাখা গাছ কাটিয়া কংক্রিটের জঙ্গল গড়া হইতেছে। প্রাকৃতিক ভাবে গড়িয়া উঠা চিরহরিৎ অরণ্যের স্থানে দেখা মিলিতেছে পরিকল্পিত বনভূমির, সান্ত্বনা পুরস্কারের ন্যায়। বিপর্যয় আসিবে না?
তবে কি পরিবেশ রক্ষায় উন্নয়ন স্তব্ধ হইবে? অবশ্যই নহে। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখিবার দায়টি সরকারেরই। উন্নয়ন জনগণের স্বার্থে। কিন্তু উন্নয়নের তাড়নায় সেই জনগণকেই প্রকৃতির রুদ্ধরোষের সামনে বেআব্রু করিয়া দেওয়া সবিশেষ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। অথচ, ভারতে ঠিক তাহাই ঘটিতেছে। বস্তুত, এই দেশে দল-নির্বিশেষে সমস্ত সরকার উন্নয়ন বলিতে বুঝে কিছু উড়ালপুল, ঝকঝকে রাস্তা এবং কংক্রিট কাঠামো। উন্নয়নের সামগ্রিক রূপ, যাহার মধ্যে পরিবেশ রক্ষাও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, এই দেশের শাসকদের নির্বাচনকেন্দ্রিক মানসিকতায় স্থান পায় না। পরিবেশ ভোট দিতে পারে না। সুতরাং, তাহার স্বার্থ দেখিবার দায়ও সরকারের নাই। মনে রাখা প্রয়োজন, ১০০ বৎসর পূর্বে মানবসমাজের উন্নয়ন বলিতে যাহা বুঝাইত, এখন তাহা নহে। উষ্ণায়নের কারণে বিপন্ন হইয়াছে পরিবেশ। হিমবাহ গলিতেছে, নদী শুকাইতেছে, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। এমতাবস্থায় পরিবেশের কথাটি ভুলিয়া বেহিসাবি উন্নয়নে মাতিবার অর্থ পৃথিবীকে আরও দ্রুত ধ্বংসের দিকে ঠেলিয়া দেওয়া। বিপর্যয়-অন্তে প্রার্থনা, পাশে থাকিবার বার্তা বা ক্ষতিপূরণের আশ্বাসের সেই অমোঘ পরিণতিকে আটকাইবার ক্ষমতা নাই। ভারত সরকার শুনিতেছে কি?