সাধারণ নাগরিকের তথাপি আশায় বুক না-বাঁধিয়া গতি নাই। অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের বাজেটের নিকট অনেকের অনেক রকম প্রত্যাশা থাকিবে। কিন্তু, এক শত চল্লিশ কোটির সিংহভাগ চাহিবে মাত্র দুইটি জিনিস: এক, যথেষ্ট কর্মসংস্থান; দুই, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। দুইটি চাহিদাই মানুষের অন্ন-বস্ত্রের প্রাথমিকতম প্রশ্নের সহিত অঙ্গাঙ্গি জড়িত। এবং, দুইটি সমস্যার সমাধান করা— বস্তুত, সমস্যা দুইটির যুগপৎ সমাধান করা— যে কতখানি কঠিন, অর্থমন্ত্রী বিলক্ষণ জানিবেন। অর্থশাস্ত্রের তত্ত্ব বলে, মূল্যস্ফীতির হার ও বেকারত্বের হার পরস্পরের সহিত ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে বাঁধা। মূল্যস্ফীতির হার কমিলে বেকারত্বের হার বাড়িবে। কর্মসংস্থানের জন্য গতিশীল অর্থব্যবস্থা প্রয়োজন। অর্থব্যবস্থাকে গতিশীল করিতে হইলে শিথিল মনিটরি পলিসি বা মুদ্রানীতির পথে হাঁটাই বিধেয়। ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তাহাই করিতেছে— সুদের হার এখনও যথেষ্ট কম। কিন্তু, সুদের হার কম থাকিলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়িবার সম্ভাবনা অধিক হয়। বাজেটে মুদ্রানীতির গতিপথ স্থির করিবার অবকাশ নাই, তাহা সত্য— কিন্তু, সরকারের সামগ্রিক আর্থিক নীতি যাহাতে শিথিল মুদ্রানীতির অপরিহার্যতাকে মাথায় রাখিয়াই রচিত হয়, তাহা নিশ্চিত করা জরুরি। বস্তুত, কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতির মধ্যে যে কোনও একটি সমস্যার মোকাবিলা করিতে হইলে প্রথমটিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া বিধেয়। মূল্যস্ফীতি নিশ্চিত ভাবেই অর্থব্যবস্থার ক্ষতি করে, কিন্তু হাতে উপার্জন থাকিলে বর্ধিত মূল্যস্তরের সহিত লড়াই করিবার কাজটি সাধারণ মানুষের পক্ষে সহজতর হয়। দ্বিতীয়ত, মূল্যস্ফীতির সমস্যাটি অন্তত আংশিক ভাবে হইলেও এমন কিছু বিষয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়, যাহা প্রত্যক্ষ ভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন নহে। যেমন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম। সুতরাং, যাহা আয়ত্তাধীন, প্রথমে সেই কাজে মন দেওয়াই বিধেয়।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যটি সরাসরি অর্থব্যবস্থার স্বাস্থ্যের সহিত জড়িত। বাজার চাঙ্গা হইলে তবেই উৎপাদন বাড়িবে, কর্মসংস্থান হইবে। আবার, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না থাকিলে বাজারে চাহিদা বাড়িবে কোন পথে? এখানেই সরকারের ভূমিকা। লাগামছাড়া রাজকোষ ঘাটতি সাধারণত দুশ্চিন্তার বিষয়, কিন্তু পরিস্থিতিভেদে তাহা বিশল্যকরণীর কাজ করিতে পারে। আপাতত ঘাটতির কথা না ভাবিয়াই সরকারকে ব্যয় করিতে হইবে— এমন ক্ষেত্রে, যাহাতে কর্মসংস্থান ঘটে। জাতীয় কর্মসংস্থান যোজনার ন্যায় প্রকল্পে ব্যয় করা জরুরি, কিন্তু তাহাই যথেষ্ট নহে। এমন ক্ষেত্রে ব্যয় করা প্রয়োজন, যাহা একই সঙ্গে বর্তমানে কর্মসংস্থান করিবে, এবং ভবিষ্যতের আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করিবে। পরিকাঠামো তেমনই একটি ক্ষেত্র। এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী পরিকাঠামো নির্মাণের খাতে কতখানি বরাদ্দ করেন, তাহা আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সমস্যার সমাধানের গতিপথ নির্দিষ্ট করিয়া দিবে। এক দিকে যেমন বাহ্যিক পরিকাঠামো প্রয়োজন— বিদ্যুৎ, সড়ক, বন্দর, বিমানবন্দর ইত্যাদি— অন্য দিকে তেমনই সামাজিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রেও বরাদ্দ বৃদ্ধি প্রয়োজন। বিশেষত স্বাস্থ্যখাতে পরিকাঠামোয় বর্ধিত লগ্নি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ, সময়ের উভয় পরিসরের পক্ষেই অতি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থব্যবস্থার চাকা এক বার ঘুরিতে আরম্ভ করিলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পক্ষে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কাজটি সহজতর হইবে।