পরিচর্যা প্রয়োজন সমাজের। অতিমারি-পর্ব পেরিয়ে প্রবীণদের নিঃসঙ্গতা, শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা যখন পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তখন সমান তালে বেড়েছে ‘ভাল থাকা’ এবং ‘ভাল রাখা’র প্রয়োজনও। কিন্তু পৃথক ভাবে পরিচর্যাকারী নিয়োগের সংস্থান সকল পরিবারের থাকে না। অপর দিকে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে মেয়েদের, বিশেষত গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রগুলিও সঙ্কুচিত হয়েছে। এই দুইটি পৃথকধর্মী সমস্যাকে এক সুতোয় বুনতে পঞ্চায়েত এলাকায় ‘আনন্দধারা’, অর্থাৎ গ্রামীণ কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে ‘সেবাসখী’ নামে এক নতুন শ্রেণির কর্মিবর্গ গড়ে তোলার উদ্যোগ করছে সরকার।
এই উদ্যোগ স্বাগত। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় ‘কমিউনিটি কেয়ারগিভার’দের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পূর্বে একান্নবর্তী পরিবারে পরিচর্যা, সঙ্গ দানের মতো বিষয়গুলির অভাব তেমন ভাবে পরিলক্ষিত হত না। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেই প্রয়োজন বাড়ছে। শহরে তো বটেই, গ্রামাঞ্চলেও একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। অসহায়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই পরিবারের শিশু, প্রবীণদের। এমতাবস্থায় সরকারি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত মেয়েরা যদি প্রাথমিক পরিচর্যা প্রদানের কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন, তবে কিছু বাড়তি ভরসা মেলে। রোগীদের ক্ষেত্রেও যাঁদের বিশেষ পরিচর্যা প্রয়োজন, অথচ হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা কাজে আসতে পারে। এই কথাটি মাথায় রেখেই প্রশিক্ষণের পাঠ্যক্রম তৈরি করা হয়েছে। সেখানে ফিজ়িয়োথেরাপি, যোগব্যায়াম শেখানো, শয্যাশায়ী রোগীর বিশেষ সেবাযত্ন করা এবং নিঃসঙ্গ প্রবীণদের সাহচর্য দানের ন্যায় বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০ লক্ষ স্বনির্ভর গোষ্ঠী রয়েছে। তাদের আওতায় থাকা মহিলাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন এবং পঞ্চায়েত দফতর যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, অর্থাৎ বছরখানেকের মধ্যে অন্তত ১০০টি ব্লকে সেবাসখীদের নিয়োগ করা হবে, সেই অনুযায়ী এগোলে গ্রামের মেয়েদের এক বিরাট অংশের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা। বর্তমান পরিস্থিতিতে এর মূল্য বড় কম নয়।
আশা ও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মতো সেবাসখীরাও অত্যন্ত কম বেতনভুক এক শ্রেণির কর্মীতে পরিণত হবেন, এই আশঙ্কা থাকছে। তাঁদের রোজগারের সুরক্ষা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো বিষয়গুলি মানা হবে না, এই আশঙ্কাও প্রকট। যে অভিযোগ আশা এবং অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের ক্ষেত্রে বার বারই উঠেছে। কম বেতনের পাশাপাশি চাপিয়ে দেওয়া কাজের পাহাড়, মাতৃত্বকালীন ছুটির স্বল্পতা, অনুপস্থিতিজনিত কারণে বেতন কাটার মতো নানাবিধ অবিচারের শিকার হয়েছেন তাঁরা। সুতরাং, সেবাসখীদের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে, তাঁরা যেন শ্রমের মূল্য এবং এক জন কর্মীর যথাযথ সুরক্ষাটুকু পান। এই ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত দফতরের সঙ্গে স্বাস্থ্য দফতরের সমন্বয় রেখে কাজ করতে হবে। এই কর্মীদের বেতন কী ভাবে প্রদান করা হবে, কোন ফান্ড থেকে আসবে, তা নির্দিষ্ট করার পাশাপাশি কাজের শর্তগুলিকেও স্পষ্ট করতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাঁরা কর্মী। তাই কর্মীর মর্যাদা হতে তাঁরা যেন বঞ্চিত না হন, নিশ্চিত করতে হবে সেটা।