Underage Marriage

কার শাস্তি

বিবাহিত মেয়েদের অধিকারের সুরক্ষায় নানা আইন থাকা সত্ত্বেও তারা ‘অনাথবৎ’। শ্বশুর-স্বামীর সম্পত্তির অংশ থেকে, এমনকি সামান্য খোরপোশ থেকে, অতি সহজেই বঞ্চিত করা যায় মেয়েদের।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৪৬
Share:

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

কোনও সময়ে নাবালিকাকে বিয়ে করে থাকলে সে বিয়ে পরবর্তী কালেও নথিভুক্ত হবে না, কিছু দিন আগে রাজ্য সরকার এমনই নির্দেশ দিয়েছে। সাম্প্রতিক সমীক্ষা দেখিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহ কোনও ভাবেই কমানো যাচ্ছে না, বরং রাজ্যের তিন জেলায় (মুর্শিদাবাদ, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর) ৬০ শতাংশেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে আঠারো বছরে পড়ার আগে। জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (২০১৯-২১) বলছে, রাজ্যে আঠারো বছরের আগে ৪১ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, যা জাতীয় গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পের পরও নাবালিকা বিবাহের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের এই পরিস্থিতি রাজ্য সরকারের কাছে কেন অপ্রিয় বুঝতে অসুবিধা হয় না, বৃহত্তর সমাজের পক্ষেও তা ঘোর দুঃসংবাদ। মুশকিল হল, অনাচার দেখে প্রশাসন নথিভুক্তিকরণ বন্ধ করার বেতটি চালিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সে আঘাত শেষ পর্যন্ত গিয়ে পড়তে চলেছে নাবালিকারই পিঠে। নাবালিকার বিয়ে যদি কখনওই নথিভুক্ত করা না যায়, তা হলে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তির উত্তরাধিকার তারা হারাবে। সন্তানের জন্মের শংসাপত্র পাওয়া না গেলে আতান্তরে পড়বে সেই সব বিবাহের সন্তান, এবং তাদের মায়েরাই। অথচ, প্রহার-উদ্যত বেতের তলা দিয়ে স্বচ্ছন্দে বেরিয়ে যেতে পারবে পুরুষেরা, কারণ নাবালিকা মেয়ের বিয়ে দিয়ে তারা পণের অঙ্কে কিঞ্চিৎ ছাড় পেয়ে যাবে, আবার বিবাহিতা কন্যার ভরণপোষণের ভার অস্বীকারও করতে পারবে। পারিবারিক সম্পদে বধূর ভাগ— বিশেষত সন্তানহীন বধূর ভাগ— অস্বীকার করা যাবে। নাবালিকা বিবাহের বৈধতা প্রমাণ করা অসম্ভব হলে শ্বশুরের সঙ্গে শ্বশুর-পুত্রদেরও সুবিধা, তাঁরা ইচ্ছামতো বহুবিবাহ প্রথার নতুন সংস্করণে মন
দিতে পারেন।

Advertisement

বিবাহিত মেয়েদের অধিকারের সুরক্ষায় নানা আইন থাকা সত্ত্বেও তারা ‘অনাথবৎ’। শ্বশুর-স্বামীর সম্পত্তির অংশ থেকে, এমনকি সামান্য খোরপোশ থেকে, অতি সহজেই বঞ্চিত করা যায় মেয়েদের। পাশাপাশি, মেয়েদের স্নেহ-ভালবাসার উপর চাপ সৃষ্টি করে, তাদের মধ্যে অপরাধবোধ তৈরি করে, বাপের বাড়িতে বসবাসের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়, বাবার সম্পত্তি তারা দাবিও করতে পারে না। পশ্চিমবঙ্গে নাবালিকা বিবাহের সঙ্কট অনেক দিনের, বিভিন্ন সরকারের বিভিন্ন প্রচেষ্টাতেও তা রোধ করা যায়নি। কন্যাশ্রী, রূপশ্রীর মতো প্রকল্প কেন কাজ করল না, কেন এখনও স্কুলের পড়াশোনা মেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় হচ্ছে না, কোন আশা বা আশঙ্কা পরিবারগুলিকে চালিত করছে নাবালিকার বিয়ে দিতে, কিংবা অল্পবয়সিদের অকালবিবাহে উৎসাহিত করছে, বা উপায়ান্তর বিহীন ভাবে তাদের সেই বিবাহ মেনে নিতে বাধ্য করছে— অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রয়োজন, সরকারি প্রকল্পগুলির সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু শাস্তির খাঁড়ার চেহারা এই রকম হলে তা হবে এক অন্যায়ের উপর আর এক অন্যায়। সামাজিক অন্যায়ের উপর প্রশাসনিক অন্যায়। ধরে নেওয়া যায়, এর ফলে লিঙ্গসাম্যের সূচকে আরও পতন ঘটবে রাজ্যের।

নাবালিকা বিবাহ নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই সরকারের কর্তব্য, কিন্তু সেই সঙ্গে সমাজেরও। নিয়মে কঠোরতা আনলে যদি মেয়েদের বিপন্নতা বাড়ে, তাতে হিতে বিপরীত হবে। ইতিমধ্যেই নাবালিকা মায়েরা নানা ভাবে বঞ্চিত হচ্ছে— আঠারো বছর বয়সের কম মেয়েদের নাম কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে তোলা যাচ্ছে না বলে অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্পে গর্ভবতী ও শিশুদের প্রাপ্য খাবার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। জন্মনিয়ন্ত্রণের পরামর্শ বা পরিষেবা পাচ্ছে না। অপুষ্টি, অশিক্ষা, দারিদ্র, গৃহহিংসা, এমন নানা সঙ্কটে এই কিশোরী মায়েরা বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রের কাজ এই মেয়েদের অধিকার সুরক্ষিত রাখা, তাদের সার্থক ও সুস্থ জীবনের পথ দেখানো। যে সংস্কারে মেয়েরাই শেষ অবধি বঞ্চিত হবে, তার মাধ্যমে লিঙ্গসাম্য আনা অসম্ভব।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement