ফাইল চিত্র।
নাবালিকা কন্যা বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে মুসলিম আইন মেনে স্বেচ্ছায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে, সেই বিবাহ গ্রাহ্য হবে। সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। বিবাহ সংক্রান্ত এক মামলার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি এমন রায় দিয়েছে দিল্লি হাই কোর্ট। আদালত আরও জানিয়েছে, এ ক্ষেত্রে মেয়েটির বয়স ১৮ অনূর্ধ্ব হওয়া সত্ত্বেও সে স্বামীর সঙ্গেই থাকতে পারবে, এবং তাদের ব্যক্তিগত জীবনে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। পকসো আইনে মামলা গ্রাহ্য হবে না মেয়েটির স্বামীর বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত, ইতিপূর্বেই মেয়েটির অভিভাবকরা তার স্বামীর বিরুদ্ধে পকসো আইনে অভিযোগ জানিয়েছিলেন। এর প্রেক্ষিতেই সুরক্ষার আবেদন জানিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয় ওই দম্পতি।
মহামান্য আদালতের রায় শিরোধার্য মেনেও প্রশ্ন তোলা হয়তো অসঙ্গত হবে না যে, এই রায়ে কি এক দিকে ভারতে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে আইনসম্মত বয়সসীমা এবং অন্য দিকে যৌন হেনস্থার হাত থেকে শিশু সুরক্ষা আইন— উভয়ই একযোগে লঙ্ঘিত হল না? মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা, তার পারিবারিক পরিস্থিতি সুস্থ জীবনযাপনের প্রতিকূল— এমত যুক্তিও কি গুরুত্বপূর্ণ আইন লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিপন্ন হতে পারে? আইন দেশের সকল নাগরিকের উপর সমান ভাবে প্রযোজ্য। সেখানে ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায় ভেদে ব্যতিক্রম থাকা উচিত নয়। কোনও নাগরিক বা নাগরিকসমূহ সেই আইন অগ্রাহ্য করলে তা শাস্তিমূলক অপরাধ। সত্য যে, ভারতে এখনও বিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলিতে হিন্দু, মুসলিম ও খ্রিস্টানদের জন্য পৃথক ব্যক্তি আইন প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ১৯৫০ সালে সংবিধান কার্যকর হওয়ার সময়ে পরিস্থিতি বিচারে বিভিন্ন ব্যক্তি আইন মেনে নেওয়া হলেও তা কখনও সংবিধানের মূল লক্ষ্য ছিল না। সেই কারণেই রাষ্ট্রের নির্দেশমূলক নীতি হিসেবে ৪৪ নম্বর ধারাটি অন্তর্ভুক্ত হয়, যেখানে বলা হয়— প্রয়োজনে রাষ্ট্র সমগ্র দেশের নাগরিকের জন্য এক অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করতে পারে। এই ধারার মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল, বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য দূর করা। স্বয়ং আম্বেডকরও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সুতরাং, সেই অভিমুখে যাত্রা করাটাই আধুনিক ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
এবং দেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই অন্য একটি প্রশ্নও এ ক্ষেত্রে তোলা যায়। প্রসঙ্গ যেখানে নাবালিকা বিবাহ, সেখানে কি বিবাহের ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত আইনটির প্রেক্ষাপট বিবেচ্য হওয়া উচিত ছিল না? বিষয়টি এখানে কোনও নির্দিষ্ট ধর্মীয় আইনের নয়, কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ভাবাবেগেরও নয়। এটি একটি অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের সার্বিক সুরক্ষা, তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং তার শিক্ষার প্রশ্ন। নাবালিকা বিবাহের বহু আলোচিত ক্ষতিকর প্রভাবগুলির কথা মনে রাখলে ব্যতিক্রমের কোনও অজুহাতই যথেষ্ট হতে পারে না। ভারতে এখনও ২৭ শতাংশ মেয়ের আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই বিবাহ সম্পন্ন হয়, ৭ শতাংশ সন্তানধারণ করে। এমতাবস্থায়, পুরনো আইনের আধারে বাল্যবিবাহকে বিচার করলে তা দেশের উন্নয়নের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়াবে। প্রয়োজন, যুগোপযোগী পদক্ষেপের। আশা, দেশের বিচারব্যবস্থা সেই পথই দেখাবে।