বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারি যখন কোভিড-১৯’কে আন্তর্জাতিক স্তরে আপৎকালীন স্বাস্থ্য বিপর্যয় হিসাবে ঘোষণা করেছিল, তখন অনেকে এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে সম্প্রতি যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল টেড্রস অ্যাডানম গেব্রিয়েসাস ইমার্জেন্সি কমিটি-র পরামর্শের ভিত্তিতে ঘোষণা করলেন যে, কোভিড-১৯ আর আন্তর্জাতিক অতিমারি নয়, গোটা বিশ্ব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বইকি। এই ঘোষণার কয়েক মাস আগে থেকেই অবশ্য বহু বিশেষজ্ঞ কোভিড-কে মরসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার পর্যায়ভুক্ত করার কথা বলে আসছিলেন। ফলে, এমন ঘোষণা ছিল সময়ের অপেক্ষা। যদিও মার্চ-এপ্রিল মাসে ভারত-সহ এশিয়া এবং ইউরোপের বেশ কিছু অংশে কোভিড সংক্রমণ বাড়তে দেখা যায়, তবে গত বছর একমাত্র চিন ছাড়া অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা যা বলে, সাম্প্রতিক কোভিড স্ফীতিতেও তার পুনরাবৃত্তি ছিল স্পষ্ট— ভাইরাসটি ক্রমে কম ভয়ঙ্কর হয়েছে। ২০২১ সালের গোড়ায়, অতিমারি যখন তুঙ্গে, তখন যেখানে সপ্তাহে লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছিল— সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে কোভিডে মৃতের সংখ্যা ২০০ জনেরও কম।
কোভিড-পূর্ব বিশ্বেও অন্যান্য ভাইরাসের কারণে প্রায় মহামারি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। ইবোলা, সার্স, মার্স তেমনই কিছু উদাহরণ। কিন্তু এদের কারও সংক্রমণ ক্ষমতা সার্স-কোভ-২’র মতো ছিল না, যার কারণে গত তিন বছরে প্রাণ গিয়েছে প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষের। অতিমারির প্রাদুর্ভাবের সময় অনেকেরই আশঙ্কা ছিল যে, এর প্রভাব বহু কাল ধরে ভোগ করতে হবে। অতঃপর বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এক বছরের মধ্যেই এই ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার সম্ভব হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভাইরাসের ধার আরও অনেক কাল ধরে অব্যাহত থাকে এবং তার কারণে ভারত-সহ বহু দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার খামতিগুলি প্রকট হয়। তবে সেই কঠিন সময় একটি শিক্ষা দিয়েছিল— দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার পরিকাঠামোকে যথেষ্ট পরিমাণে উন্নত করা, যা শুধু উন্নয়নশীল দেশগুলির ক্ষেত্রেই নয়, আমেরিকার মতো উন্নত দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, সেখানেও সমাজের দরিদ্র শ্রেণি কোভিডের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হয়েছে।
এটা ঠিক যে, কোভিডের নতুন ভেরিয়্যান্ট এবং সাব-ভেরিয়্যান্টগুলি আগের তুলনায় মারণক্ষমতা হারিয়েছে, কিন্তু ভাইরাসটি এখনও মুছে যায়নি। শুধু তা-ই নয়, বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতে এমন আরও অনেক ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটবে, যেগুলির মারণক্ষমতা হয়তো কোভিডের থেকেও বেশি। সেই কারণেই আত্মতুষ্টিতে না ভুগে বিশ্বের সব দেশ, বিশেষত ভারতকে স্বাস্থ্য পরিষেবা আরও উন্নত করার বিষয়ে জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে নতুন ধরনের ভাইরাসের উপর প্রতিনিয়ত নজরদারি চালাতে হবে, এবং দেখতে হবে আগামী অতিমারির জন্য বিশ্ব কতখানি প্রস্তুত। বলা বাহুল্য, করোনার আবির্ভাব জিনোম সিকোয়েন্সিং, টিকা তৈরি, অ্যান্টি-ভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে গবেষণার গুরুত্ব বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এমন পদক্ষেপ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অতিমারির জন্য প্রস্তুত থাকতে সাহায্য করবে। কোভিড-এর শিক্ষা উপেক্ষা করলে ক্ষতি মানবজাতিরই।