ভোটের চেয়ে বড় বালাই যে আর হয় না, ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী তা বিলক্ষণ টের পাচ্ছেন। সাম্প্রতিকতম প্রমাণ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পেনশন প্রকল্প। ২০০৪-এ অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় চালু হওয়া ন্যাশনাল পেনশন সিস্টেম (এনপিএস)-কে বাতিল করা হল না বটে, কিন্তু পাশাপাশি চালু হল ইউনিফায়েড পেনশন স্কিম (ইউপিএস)। সব কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীই এর আওতায় আসবেন, চাইলে রাজ্য সরকারগুলিও এই প্রকল্প চালু করতে পারে। এনপিএস-এর সঙ্গে এই নতুন প্রকল্পের মূল ফারাক: এখানে ন্যূনতম নিশ্চিত পেনশনের প্রতিশ্রুতি রয়েছে— অবসরগ্রহণের আগে যাঁরা অন্তত ২৫ বছর চাকরি করেছেন, তাঁদের ন্যূনতম পেনশন হবে শেষ বারো মাসের বেসিক ও মহার্ঘ ভাতার অন্তত ৫০ শতাংশ। ন্যূনতম দশ বছর চাকরি করলে নিশ্চিত পেনশনের পরিমাণ ১০,০০০ টাকা। পাশাপাশি রয়েছে মূল্যস্ফীতি-সংস্থাপকতা, অর্থাৎ যেমন যেমন মূল্যস্ফীতি ঘটবে, পেনশনের পরিমাণও নির্দিষ্ট সময় অন্তর সে হারে বাড়বে। এনপিএস নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের প্রধান আপত্তি ছিল তার অনিশ্চয়তায়— কত পেনশন মিলবে তা নির্ধারিত হত শেয়ার বাজারের চলনের ফলে। নতুন ব্যবস্থায় সেই অনিশ্চয়তা কাটবে। তবে, পেনশন ফান্ডের চরিত্র যে-হেতু অপরিবর্তিত রাখা হচ্ছে, ফলে টাকা খাটবে শেয়ার বাজারেই— অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের নিশ্চিত পেনশন দিতে হলে বাজারের ঝুঁকিটি তবে সরকারকে হজম করতে হয়। সেই ‘ফিসক্যাল-স্পেস’ সরকারের আছে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর এই প্রকল্পের ঘোষণার সময় স্বভাবতই পাওয়া যায়নি।
বাজপেয়ী-জমানায় পেনশন সংস্কারের পিছনে সর্ববৃহৎ কারণটি ছিল, পুরনো পেনশন ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান পেনশনের বোঝা টানা রাজকোষের পক্ষে অসম্ভব হচ্ছিল। সেখান থেকেই ‘ফান্ডেড’ প্রকল্পের ধারণা: একটি পৃথক তহবিল গঠন করে তাতে পেনশনের টাকা আলাদা করে রাখা। তহবিলের একটি অংশ আসে কর্মীদের বেতন থেকে, অন্য অংশ দেয় সরকার। কর্মীর প্রদেয় অংশটি তাঁদের বেতনের অনুপাতে অপরিবর্তিত থাকলেও সরকারি অংশীদারির পরিমাণ দফায় দফায় বেড়েছে, বর্তমান প্রকল্পে অনুপাত দু’টি যথাক্রমে কর্মীর মূল বেতনের ১০ ও ১৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ, সরকারের উপরে পেনশন খাতে আর্থিক বোঝা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন— যে দেশের নব্বই শতাংশের বেশি মানুষ এখনও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত, বাকিদেরও বেশির ভাগেরই কর্মসংস্থান বেসরকারি ক্ষেত্রে, সেখানে সরকারি কর্মীরা এমনিতেই চাকরিজীবী শ্রেণির মধ্যেও সবচেয়ে বেশি সুবিধাপ্রাপ্ত। তাঁদের পেনশনের প্রতি সরকারের সুগভীর মনোযোগকে সামাজিক সাম্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন, প্রতি বার।
তাকানো প্রয়োজন বৃহত্তর প্রশ্নটির দিকেও— পেনশন বস্তুটি ঠিক কী? এর অন্তত তিন রকম উত্তর সম্ভব— এক, বেতনেরই একটি অংশ, যা পরবর্তী কালে দেওয়া হচ্ছে; দুই, দীর্ঘ দিন চাকরির সুবাদে অর্জিত অধিকার; এবং তিন, অবসরগ্রহণের পরেও সুস্থ জীবনযাপনের জন্য নাগরিকের প্রাপ্য সুবিধা। স্পষ্টতই, প্রথম উত্তরটি বাদে বাকি দু’টিতে সরকারি কর্মীদের একচেটিয়া অধিকার থাকার কারণ নেই। আদর্শ পরিস্থিতিতে, কোনও নাগরিকের জন্য পেনশনের অধিকার স্বীকার করতে হলে তা সব নাগরিকের ক্ষেত্রেই সমান ভাবে স্বীকার্য। অর্থাৎ, কর্মক্ষম বয়ঃক্রম-অতিক্রান্ত নাগরিকদের ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের (বা অন্য সুবিধা) ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্র। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে সে দাবি করা অবাস্তব, বিপজ্জনকও। কিন্তু, দেশের সিংহভাগ মানুষ যে সুবিধা থেকে বঞ্চিত, মুষ্টিমেয় সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির জন্য সেই সুবিধাকে আরও আকর্ষক করে তোলার মধ্যে নির্বাচনী রাজনীতি যতখানি থাকে, বণ্টনের ন্যায্যতার দর্শন ততখানি নয়।