সব জেনেও নিষ্ক্রিয় থাকার মতো এক অনন্য প্রতিভার অধিকারী কলকাতা পুরসভা। পুরসভা জানে, কী থেকে নগর ও নগরবাসীর সমূহ ক্ষতি হতে পারে, সেই ক্ষতি রুখতে কী ব্যবস্থা করা প্রয়োজন, এবং সেই নিয়ম না মানলে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে কী শাস্তি দেওয়া উচিত। অথচ, কার্যক্ষেত্রে হামেশাই কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ে না। শহরে নির্মাণ-বর্জ্যের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। দেড় বছর পূর্বে শহরে যত্রতত্র নির্মাণ-বর্জ্য ফেলে রাখার শাস্তিস্বরূপ সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপর জরিমানা ধার্য করার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল কলকাতা পুরসভা। কোন অপরাধে কত অর্থ জরিমানা হতে পারে, সেই বিষয়টিও আলোচিত হয়েছিল। ধারাবাহিক ভাবে নিয়মভঙ্গকারীদের ক্ষেত্রে জরিমানার অঙ্ক দ্বিগুণ করার প্রস্তাবও গৃহীত হয় সেই সময়। অতঃপর কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এত দিনেও ওই খাতে কোনও জরিমানা আদায় করা হয়নি। নির্মাণ-বর্জ্যের বিপদ থেকে শহরের মুক্তিও মেলেনি।
বিপদটি সামান্য নয়। বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে কলকারখানা নিঃসৃত ধোঁয়া, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং বাজির দূষণ নিয়ে যত আলোচনা চলে, নির্মাণ-বর্জ্যের দূষণ নিয়ে ততটা নয়। অথচ, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ১০) ও অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা (পিএম ২.৫) উভয়ই বৃদ্ধির পশ্চাতে নির্মাণ-বর্জ্যের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। দিল্লিতে ঘোরতর বায়ুদূষণের দিনগুলিতে সরকারের পক্ষ থেকে শহর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যাবতীয় নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ থেকেই স্পষ্ট, কেন এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব এত বেশি। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে ২০১৬ সালে ‘কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেমোলিশন ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুল’ তৈরি হয়েছিল। সেখানে সুস্পষ্ট ভাবে এই বর্জ্যের সংজ্ঞা নিরূপণ করা হয়েছিল, কী ভাবে তা উৎপন্ন হতে পারে সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল, এবং তার সংগ্রহ, পৃথকীকরণ ও প্রক্রিয়াকরণের বিষয়েও বলা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও সমগ্র দেশে যে বিপুল পরিমাণ নির্মাণ-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, তার অতি সামান্য পরিমাণ প্রক্রিয়াকরণের আওতায় আসে। বাকি অংশ যত্রতত্র স্তূপীকৃত থেকে বায়ু, জল, মাটির দূষণ ঘটিয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গ এই দূষণ তালিকায় অন্যতম।
অথচ, নির্মাণ-বর্জ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য। যে কোনও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেই তাকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলার সম্ভাবনাটি খতিয়ে দেখা এক অন্যতম দিক। বছর ছয়েক আগে নির্মাণ-বর্জ্যকে ‘বর্জ্য’ না বলে তাকে নির্মাণ-উপাদান বলার পরামর্শ দিয়েছিল এক কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাতে দেশের বায়ুদূষণও নিয়ন্ত্রণে থাকার সম্ভাবনা। এ শহরে সেই কাজের অগ্রগতি কত দূর, নাগরিকের জানা প্রয়োজন। অভিযোগ, নির্মাণ-বর্জ্য নিয়ে একাধিক বার মেয়র ফিরহাদ হাকিম সরব হওয়া সত্ত্বেও পুরসভা এখনও অবধি নিয়মভঙ্গকারীদের নিছক সতর্ক করাতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। এমনকি, বর্জ্যবাহী ১৫ বছরের পুরনো লরিগুলির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা করা হয়নি বলে অভিযোগ। অভিযোগ, রাজারহাট-নিউ টাউনের নতুন নির্মাণ-বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্লান্টটিতে বর্জ্য প্রেরণ নিয়েও। এই সব অভিযোগের সমাধান হয়েছে কি না, তা স্পষ্ট করা জরুরি শহরের নির্মল বায়ুর স্বার্থে। একই সঙ্গে গতি আসুক অবাধ্যদের জরিমানা আদায়েও। অপরাধ জানা, তাকে মোকাবিলার আইন মজুত, এখনও কোন সুদিনের অপেক্ষা করছে পুরসভা?