সংসদে রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।
রাহুল গান্ধী জানিয়েছেন, এ বার কংগ্রেস সাংসদদের রিপোর্ট কার্ড তৈরি হবে। সংসদে বলার সুযোগ পেলে কে কতখানি তৈরি হয়ে আসছেন, কে জনস্বার্থে কতগুলি নোটিস জারি করছেন, কে স্থানীয় সমস্যার কথা তুলে ধরছেন আইনসভার কক্ষে, সে সবের হিসাব নিয়ে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা ও সাংসদদের একটি কমিটি রিপোর্ট কার্ড তৈরি করবে। প্রস্তাবটি আদৌ বাস্তবায়িত হবে, না কি রাহুল গান্ধীর হরেক সদিচ্ছার মতো এটিরও ঠাঁই হবে বাতিল কাগজের ঝুড়িতে, সে প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যৎ জানে। কিন্তু, প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল কথা হল, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মানুষের সমস্যা, দাবিদাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দুশ্চিন্তার কথা তুলে ধরবেন দেশের সর্বোচ্চ আইনকক্ষে। শুধু স্থানীয় সমস্যার কথাই অবশ্য নয়, সাংসদদের কাজ দেশের নীতিনির্ধারণের প্রশ্নে নিজেদের মতামত দেওয়া, সে কথা শুনতে সরকারকে বাধ্য করা। তার জন্য প্রস্তুতি প্রয়োজন। এক কালে সাংসদদের বক্তৃতা শোনার মতো বস্তু ছিল— যেমন তাঁদের বাচনভঙ্গি ছিল, তেমনই ছিল বিষয়ের উপরে দখল, বিশ্লেষণী ক্ষমতা। সুদূর অতীতের উদাহরণে যদি কারও রুচি না-ও থাকে, ইতিহাসবিদ সুগত বসুর কথা মনে করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক কালে রাহুল গান্ধীর মতো সাংসদের বক্তৃতাতেও বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে সাধারণ মানুষের— তবে, এ কথাও অনস্বীকার্য যে, সে আগ্রহ যতখানি রাজনৈতিক ভঙ্গির কারণে, বিষয়বস্তুর গভীরতার কারণে ততখানি নয়। বর্তমান সাংসদদের অধিকাংশই যখন সংসদে নির্বিকল্প মৌন অনুশীলন করেন, তখন সংসদীয় প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের কুশলতা বিষয়ে রিপোর্ট কার্ড তৈরি করার প্রস্তাবটি তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। কংগ্রেসের দেখাদেখি অন্য দলগুলিও যদি এই নীতি গ্রহণ করে, তবে সভার আলোচনার মানে উন্নতি ঘটবে, এমন আশা করা যায়।
তবে, এই প্রস্তাবটির একটি গভীরতর তাৎপর্য রয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় সরকার পক্ষের সচেতন সিদ্ধান্তেই সংসদের গুরুত্ব ক্রমে হ্রাস পেয়েছে। বহু গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ হয়ে গিয়েছে বিনা আলোচনায়, কখনও কখনও অধ্যাদেশ জারি করে। গণতন্ত্রের প্রতি তাঁদের আস্থা ও সম্ভ্রমবোধ যে সুগভীর নয়, গত এক দশকে ভারত তার প্রমাণ বারে বারেই পেয়েছে। সংসদকে ক্রমে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলা সেই অনাস্থারই একটি রূপ। সরকারকে গণতন্ত্রের পথে ফিরতে বাধ্য করার দায়িত্ব বিরোধীদের। গত দু’দফার তুলনায় এ বার বিরোধীদের পক্ষে সেই কাজটি তুলনায় সহজ, কারণ এ বার তাঁরা সংখ্যায় আগের চেয়ে অনেকটাই বেশি। সরকারকে গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে হলে সে কাজটিও করতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই— সংসদের পরিসরে প্রশ্ন তুলে, সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে। সেই দায়িত্ব বিরোধী দলের সাংসদদের। তাঁরা যদি মৌন থাকেন, যদি সংসদের পরিসরটিকে নেহাত বিশ্রাম গ্রহণের জায়গা হিসাবে ব্যবহার করেন, তা হলে সরকারকে চাপে ফেলার কাজটি করার উপায় থাকে না। রাহুলের প্রস্তাবটি এই পরিস্থিতি পাল্টে দিতে পারে। গণতন্ত্রহীন, সর্বাধিপত্যকামী শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার সেরা অস্ত্র গণতন্ত্রই— তাকে কোন পরিসরে কী ভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটা জেনে নেওয়া প্রয়োজন। রাহুলের পথনির্দেশ অনুসরণ করে যদি অন্য বিরোধীরাও এই কাজটি করতে পারেন, তা হলে ভারতে গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে লড়াই একটি নতুন মাত্রা পাবে।