কোয়ান্টাম থিয়োরির সমালোচনা করে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন নাকি বলেছিলেন, বারে বারে একই কাজ করে যাওয়া, এবং ভিন্ন ফল প্রত্যাশা করাকেই পাগলামি বলে। কংগ্রেসের চিন্তন শিবির শেষ হওয়ার পর কেউ আইনস্টাইনকে স্মরণ করেছিলেন কি? শিবিরে আমন্ত্রিত নেতারা এই বারও সমস্বরে গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বেই আস্থা প্রকাশ করলেন, রাহুল গান্ধীকেই দল পরিচালনার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করলেন। এমনকি, দলের বিক্ষুব্ধ ‘জি-২৩’ গোষ্ঠীর নেতারাও বেসুরো গাইলেন না। কোনও এক বিশেষ পরিবারের হাতে দলের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত কি না, ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রশ্নটি ক্রমে অবান্তর হয়ে উঠেছে। আঞ্চলিক দলগুলি প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে পরিবারতান্ত্রিক। কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরে যে প্রশ্নটি প্রত্যাশিত ভাবেই উঠল না, তা হল, পরিবার যদি দলকে পথ দেখাতে না পারে, তবুও কি তার প্রতিই আস্থাশীল হওয়া বিধেয়? একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেসের সমূহ পরাজয় ঘটেছে। বিরোধী রাজনীতির পরিসরে দলটির গুরুত্ব অতি দ্রুত বিলীয়মান। শিবিরে দশ জনপথের দিকে আঙুল ওঠেনি— কিন্তু, এই ব্যর্থতার দায় গান্ধী পরিবারের উপরেই বর্তায়। রাহুল গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন সাক্ষী দেবে, দলের নেতৃত্ব দিতে তিনি দৃশ্যত অনিচ্ছুক; অভিজ্ঞতা বলবে, তিনি অযোগ্যও। তবুও যদি তিন দিনের চিন্তন শিবিরের শেষে দলের নেতারা তাঁর চরণকমলেই নেতৃত্বভার সঁপে দিতে ব্যাকুল হন, তবে শিবিরের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।
কংগ্রেস গত আট বছর ধরে বিরোধী আসনে রয়েছে, কিন্তু সংশয় হয়, বিরোধী রাজনীতির গতিপথ সম্বন্ধে দলের ধারণা এখনও স্পষ্ট নয়। বিরোধী সত্তায় বিজেপি যে ভাবে সামান্যতম বিষয়কেও প্রবল রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত করতে পারত, সেই তৎপরতার কণামাত্র কংগ্রেসের নেই। শুধুমাত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্য করে বিরোধী রাজনীতি হয় না। রাহুল গান্ধী জানিয়েছেন, বিজেপি-বিরোধী দলগুলির মধ্যে একমাত্র কংগ্রেসেরই আদর্শ আছে, ফলে তারাই বিজেপির যথাযথ বিরোধিতা করতে পারে। অন্য কোনও অ-বিজেপি দলের কোনও আদর্শ নেই, এই কথাটির মধ্যে যে ধৃষ্টতা ও অবিবেচনা আছে, সে প্রসঙ্গে না ঢুকেও প্রশ্ন করা প্রয়োজন, রাহুল গান্ধীদের আদর্শটা আপাতত ঠিক কী ও কেমন। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আদর্শে তাঁরা কোথায় দাঁড়িয়ে অাছেন, তা জনদৃষ্টিতে যথেষ্ট অস্পষ্ট, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থানটিও ভোটের আগে মন্দিরে মাথা ঠোকার ‘নরম হিন্দুত্ব’ দেখে গুলিয়ে যাওয়া সম্ভব। জনতার দরবারে যে স্পষ্ট আদর্শ নিয়ে নিজেদের বিজেপির বিকল্প হিসাবে পেশ করার দরকার ছিল, গত কয়েক বছরের অসক্রিয়তা ও উদাসীনতায়, সংহত চেষ্টার অভাবে সে কাজ বহু যোজন পিছিয়ে পড়েছে। দলের নেতারাও এখন নিশ্চিত নন, তাঁরা কেন বিজেপির গ্রহণযোগ্য বিকল্প বলে নিজেদের দাবি করতে পারেন। ভোট-রাজনীতিতে কংগ্রেস যে ক্রমশ গুরুত্বহীন, তার কারণটি জলের মতো সহজ।
সুতরাং বিজেপি-বিরোধী জোটকল্পনায় কংগ্রেসকে স্বাভাবিক শরিক হিসাবেও গণ্য করতে একাধিক দল এখন নারাজ। কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলে কোন দলের কত লাভ, সেই বিচার অন্যত্র। কিন্তু, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক গণতন্ত্রের জোট রাজনীতিতে নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখতে গেলে ভোটে জেতার ক্ষমতার কোনও বিকল্প নেই। কংগ্রেস সেখানে ব্যর্থ। অথচ, মুশকিল হল, উদারপন্থী ভারতের কল্পনায় কংগ্রেসের ইমেজ-টি বিগত হলেও এখনও জনমানসে উপস্থিত। সেই উপস্থিতিকে মর্যাদা দিতে হলে মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে গেলে চলবে না। দলের নেতৃত্ব দিতে অনিচ্ছুক এবং অপারগ ব্যক্তিকে বাদ দিয়েই এগোনোর সাহস থাকা চাই। নয়তো, কোনও চিন্তন শিবিরই নতুন পথ দেখাতে পারবে না।