সরকারি ব্যয়ে স্বচ্ছতা, না নাগরিকের সহায়তা, কোনটি বেশি জরুরি? সনিয়া গান্ধী কেন্দ্রীয় সরকারকে এই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছেন। দরিদ্রের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছনোর যে কয়েকটি উপায় প্রশাসনের হাতে রয়েছে, তার অন্যতম মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা প্রকল্প (এমজিএনআরইজিএ)। তার খরচের উপর নজরদারির নানা ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন, স্থানীয় বাসিন্দাদের দিয়ে খরচের পর্যবেক্ষণ (সোশ্যাল অডিট), দুর্নীতির অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য লোকায়ুক্ত নিয়োগ। এই সব ব্যবস্থা স্বস্থানে সক্রিয় না থাকলে প্রকল্পের টাকা মিলবে না, সম্প্রতি এমনই হুঁশিয়ারি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। সনিয়া গান্ধী সংসদে প্রশ্ন তুলেছেন, অর্থনীতির এই দুর্দিনে রোজগারের প্রকল্পের টাকা বন্ধ করা কি উচিত হবে? নজরদারির ব্যবস্থাগুলি কার্যকর করার কথা রাজ্য সরকারগুলির। গাফিলতি প্রশাসনের, শাস্তি কেন পাবে নাগরিক?
খাদ্যাভাব ও অপুষ্টির ছায়া ভারতের গ্রামের উপর থেকে কখনওই সরেনি, অতিমারি তাকে আরও গাঢ় করে তুলেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃষির অলাভজনকতা, অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরির নিম্নমুখিতা। ফলে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের উপর নির্ভরতা বেড়েছে। এই সময় সরকার হাত গুটিয়ে নিলে দরিদ্রের বিপন্নতা বাড়বে। অন্য দিকে, কেন্দ্রের পক্ষেও যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। দরিদ্রের সহায়তা দরিদ্রের কাছেই পৌঁছল কি না, তা না দেখে কেবলই টাকা দিয়ে যাওয়া কার্যত ফুটো চৌবাচ্চায় জল ঢালার শামিল। স্বচ্ছতা বাইরে থেকে আরোপ করার বিষয় নয়, তা প্রকল্পের পূর্বশর্ত, তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০০৫ সালে এনআরইজিএ আইনে ‘সোশ্যাল অডিট’ করার ভার দেওয়া হয়েছিল গ্রামসভাকে। রাজনৈতিক কৌশলে তা ভুয়ো স্বাক্ষরের সাক্ষ্যে পর্যবসিত হয়েছে। তাই দুর্নীতি রুখতে নানা সময়ে নজরদারির নানা বাড়তি পদ্ধতি নেয় কেন্দ্র। সোশ্যাল অডিটের জন্য নির্দিষ্ট কর্মী ও কর্মপদ্ধতি জারি, ‘জিয়োট্যাগিং’ পদ্ধতিতে প্রকল্পের অধীনে নির্মাণরত রাস্তা, পুকুরের সংযুক্তি, কর্মরত শ্রমিকদের ছবি পাঠানো— নির্দেশের পর নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। সেই সঙ্গে, যে কোনও সরকারি প্রকল্পের মতো, এনআরইজিএ-তেও দুর্নীতির অভিযোগের বিচার করার জন্য লোকায়ুক্ত থাকা প্রয়োজন। আইন পাশ হয়েছে ২০১৩ সালে, অথচ, আজও বহু রাজ্যে লোকায়ুক্ত পদ শূন্য। এর পরেও কি সরকার টাকা দিয়ে যাবে? করদাতার টাকা অপচয় রোধও কি কেন্দ্রের দায়িত্ব নয়?
সহায়তা না কি স্বচ্ছতা, কোনটি সরকারের কাছে প্রাধান্য পাবে, শেষ অবধি তা স্থির করবে রাজনীতি। তবে মূল প্রশ্নটি প্রকল্পের সুরক্ষা নয়, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষাই সরকারের প্রধান কর্তব্য। যদি এনআরইজিএ-তে দুর্নীতি রোধ দুঃসাধ্য হয়, তা হলে তার বিকল্প ভাবতে হবে। ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’-এর মতো কোনও উপায়ে দরিদ্রের সহায়তার কথা বিবেচনা করতে পারে কেন্দ্র। অপচয়-বহুল, দুর্নীতিপ্রবণ প্রকল্পের মাধ্যম গ্রহণ করার প্রয়োজন কী, তা-ও ভাবা জরুরি। তবে প্রশাসনিক পথ যা-ই হোক, সরকারের লক্ষ্য থাকতে হবে স্থির— দারিদ্রমোচন। কর্মহীনতা, খাদ্যহীনতা কার্যত জীবনের অধিকারকেই ব্যাহত করে। নাগরিকের মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা নির্বাচিত সরকারের প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। তা কোনও শর্তের অধীন নয়।