অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী সরাসরি কোনও মন্তব্য করেননি— যথারীতি। তাঁর মন কী বাত-এর অতিকায় সঙ্কলন ছাপা হয়, কিন্তু নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে প্রতিবাদের মুখে পড়ে তাঁর উদাসীন নীরবতা দেখলে মনে হয় তিনি যেন এ দেশের কেউ নন, ইদানীং বেড়াতে এসেছেন। তবে হ্যাঁ, এ-যাত্রায় সরাসরি মুখ না খুললেও তিনি একেবারে নীরব থেকেছেন এমনটা বলা যাবে না। পর পর দু’দিন, যথাক্রমে দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতে তাঁর মুখে যে বাণী শোনা গিয়েছে তার মর্মার্থ: দেশের ভাল করার উদ্দেশ্যে সরকার নীতি প্রবর্তন করতে চায়, কিন্তু ক্ষুদ্র রাজনীতির স্বার্থে অনেক লোক তার বিরোধিতা করে, সংবাদমাধ্যমও ব্যবসার তাগিদে সেই বিরোধিতাকে বড় করে প্রচার করে, তাতে দেশের ক্ষতি, দশের ক্ষতি, অথচ পরে সেই নীতির উপযোগিতা বোঝা যায়। স্পষ্টত, অগ্নিপথ-বিরোধী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেই নরেন্দ্র মোদীর এই প্রতিক্রিয়া। ঠারেঠোরে না বলে কথাটা সরাসরি বললেই পারতেন, তবে কিনা, ভক্তগণ হয়তো বলবেন প্রভুর এও এক লীলা।
প্রধানমন্ত্রীর খেদোক্তি মনে পড়িয়ে দেয় যে, প্রায় এক বছর ধরে কৃষক আন্দোলনকে ছলে বলে কৌশলে দমন করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ করার সময় তিনি একই রকম আক্ষেপের সুরে প্রায় একই কথা বলেছিলেন: কৃষকদের ভালর জন্যই তো আইন সংশোধন করতে চেয়েছিলাম, ওঁদের বোঝাতে পারলাম না! তিনি একই ধরনের সুর ভেঁজেছিলেন নোটবন্দির পরেও। তাঁর সরকার কেবলই লোকের ভাল করতে চায়, অথচ লোকে সেটা বোঝে না, কী অন্যায়! এমনকি সেনাবাহিনীতে এখন থেকে ঠিকা চাকরি হবে, চার বছরের মেয়াদ ফুরোলে অগ্নিবীররা বেকার হয়ে যাবেন, পেনশন ইত্যাদি সুযোগসুবিধাও পাবেন না, বিজেপির কার্যালয়ে অথবা নানা কোম্পানির অফিসে নিরাপত্তা কর্মী ইত্যাদি কাজের জন্য দৌড়োদৌড়ি করবেন— জনদরদি এবং সেনাদরদি সরকার এত ভাল ব্যবস্থা করছে, তবু এমন প্রতিবাদ?
মোদী সরকার এবং সেনাবাহিনীর কর্তারা ঠিক করেছেন যে, অগ্নিপথ হবেই। এমনকি আন্দোলনে জল ঢালার কৌশল হিসাবে অগ্নিবীর নিয়োগের প্রক্রিয়া নির্ধারিত নির্ঘণ্টের তুলনায় কয়েক দিন এগিয়ে আনা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হুকুম জারি হয়েছে, যাঁরা এই প্রকল্পে প্রার্থী হবেন তাঁদের মুচলেকা দিতে হবে যে, তাঁরা কোনও হিংসাত্মক আন্দোলনে যোগ দেননি। সেনাবাহিনীর তিনটি বিভাগের আধিকারিকরা নিয়মিত সাংবাদিক বৈঠক করে অনমনীয় অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছেন। প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। স্পষ্টতই, আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভূমিকা এই রাষ্ট্র স্বীকারই করে না। অগ্নিপথ প্রকল্পের পরতে পরতে অবিবেচনা এবং হঠকারিতার দগদগে ছাপ। পেনশনের খরচ বাঁচাতে (অথবা গূঢ়তর কোনও উদ্দেশ্যে) এমন নির্বোধ এবং বিপজ্জনক প্রকল্প উদ্ভাবন করাই অন্যায়। কেবল বিরোধী রাজনীতিকরা নন, রণনীতি-বিশারদ তথা ভূতপূর্ব সেনা-কর্তারাও সমস্বরে এই প্রকল্পের নিন্দায় মুখর। প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল বিষয়টির গুরুত্ব স্বীকার করে এবং সমালোচনাকে মর্যাদা দিয়ে অবিলম্বে অগ্নিপথ নিয়ে একটা সুস্থ আলোচনা ও বিতর্কের আয়োজন করা। সংসদ হত তার শ্রেষ্ঠ পরিসর। কিন্তু সেই পথে চলতে গেলে পর্বতপ্রমাণ অহমিকার চূড়া থেকে নামতে হয়, ‘যা করছি সেটাই ঠিক’— এই অবস্থান থেকে সরে এসে অপরের কথা শুনতে হয়, বিরোধী যুক্তি অনুধাবন করতে হয়। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি। সে-দাবি শুনলে অবশ্য বর্তমান শাসকরা স্বধর্মচ্যুত হবেন। সুতরাং তাঁরা ক্ষমতার জোরে অগ্নিপথ পরিষ্কার করবেনই। প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বস্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল সে-কাজে নেমেছেন। দরকার হলে হয়তো বুলডোজ়ারও নামবে।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।