ভারতে অতঃপর যে শরিকি সরকার তৈরি হতে চলেছে, তার প্রধান দলকে নিতান্ত বাধ্যত শরিকদের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। এই বাস্তব যতই পরিষ্কার হচ্ছে, দেশের সীমানার বাইরেও তার প্রভাব লক্ষিত হতে শুরু করেছে। বিষয়টি গুরুতর, কেননা গত কিছু বছরে ভারতের মতো বৃহৎ ও ভূরাজনৈতিক ভাবে শক্তিশালী দেশে হিন্দু সংখ্যাগুরুর শাসন এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চাপ প্রকট হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলিতে ভারত বিষয়ে উদ্বেগ বাড়ছিল। নরেন্দ্র মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার শাসনে একাধিক বার এই বিদেশি উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছে, দিল্লি তা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছে, বিতর্কে জড়িয়েছে। নির্বাচনের ফলকেও প্রভাবিত করার চেষ্টা চলছে, এ অভিযোগও তুলেছিল দিল্লি। এনডিএ-র জয় ও নরেন্দ্র মোদীর তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে যথাযোগ্য সব দেশই অভিনন্দন জানালেও পশ্চিম বিশ্ব যে এখনও উদ্বিগ্ন, তাতে সংশয় করা চলে না। লক্ষণীয়, ওয়াশিংটন ডিসি থেকে অভিনন্দন বার্তায় ‘বিশ্বের ইতিহাসে বৃহত্তম গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’র কথা উচ্ছ্বসিত ভাবে উঠে এলেও আমেরিকার প্রধান অর্থনীতি-মঞ্চগুলি আপাতত দিল্লির নতুন সরকারের আমলে ভারতের বাণিজ্য-গতি ও বিদেশনীতির অভিমুখ নিয়ে সাবধানি জল্পনায় নিমজ্জিত।
অনুমান করা যেতে পারে, একই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির বিষয়টি বিদেশি লগ্নিকারী সংস্থা এবং অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নকারী সংস্থার পছন্দ হবে। গত কয়েক বছরে, আমেরিকার বহু অর্থসংস্থা ও কোম্পানি ভারতীয় বাজারের দিকে চোখ রেখে মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগে লিপ্ত থেকেছে। সে দেশের আর্থিক মঞ্চে অতীব প্রভাবশালী অন্যতম বৃহৎ প্রচারমাধ্যম সোজাসুজি বলেছে, চিনের থেকে ভারতই এখন আমেরিকার প্রযুক্তি-প্রচারীদের বেশি পছন্দের গন্তব্য, তাই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাঁদের বিশেষ নজর। সন্দেহ ছিল, অপ্রত্যাশিত ফলাফলে ভারতের শেয়ার বাজারের যে পতন হয়েছিল— ২০২১ সালের পর বৃহত্তম— তা হয়তো অন্ধকার ঘনিয়ে আনবে অর্থবাজারে। কিন্তু ইতিমধ্যেই স্পষ্ট যে, তা ঘটেনি। এনডিএ-র সংখ্যাধিক্য নিশ্চিত হলে এই পুনঃস্থিতিশীলতা স্পষ্টতর হবে। শরিকি সরকারে গরিষ্ঠ দল হিসাবে বিজেপি কতখানি জোর বজায় রাখতে পারছে, তার উপরও স্থিতি নির্ভর করবে। ফলত কেবল দেশের নাগরিক সমাজই সরকার গঠনের ক্রিয়াপ্রক্রিয়া নিয়ে উৎকণ্ঠিত নয়। বিদেশের এক বিপুল অর্থবিশ্ব উদ্বিগ্ন নজর রেখে চলেছে কী ভাবে ও কোন পদ্ধতিতে শরিক সরকারের অন্তর্বর্তী ক্ষমতা সমীকরণগুলি তৈরি হয়। আয়কর সংস্কার, পরিকাঠামো সংস্কার, ক্ষমতা বণ্টন, রাষ্ট্রীয় সংস্থার বেসরকারিকরণ, অতি-আলোচিত রেলওয়ে ব্যবস্থা পুনর্গঠন থেকে শুরু করে সাইবার-নীতি, সন্ত্রাসবিরোধিতা, গোয়েন্দা কর্মপন্থা। নতুন সরকার এ সব বিষয়ে কী নীতি নিতে পারছে এবং কতটা দৃঢ় ভাবে, তা না দেখা পর্যন্ত এই উদ্বেগ প্রশমিত হবে না।
এরই সঙ্গে গুরুতর হয়ে উঠবে, নতুন সরকারের সঙ্গে কিছু প্রধান দেশের সমীকরণ— মূলত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চিন এই তালিকায় সর্বোচ্চে। এর মধ্যে কিছু কিছু প্রশ্নে যে-হেতু এই শক্তিগুলির স্বার্থ সম্পূর্ণ পরস্পরবিরোধী, ভারতের ভারসাম্য রক্ষার প্রশ্ন অতীব গুরুতর হয়ে ওঠে। স্বভাবতই একক গরিষ্ঠ দল সরকার তৈরি করলে প্রশ্নগুলির মীমাংসা যে ভাবে করা যায়, শরিকি সরকারে তা অত সহজ নয়। সহজ না হলেও অবশ্য সে কাজ অসম্ভবও নয়। প্রসঙ্গত মনে রাখা যেতে পারে, ঐতিহাসিক আমেরিকা-ভারত পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরের সময় ইউপিএ-১ সরকারের মধ্যেকার প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘাত, এবং শেষ পর্যন্ত প্রধান শাসক দলের নীতি-সাফল্য। গণতন্ত্রের এও এক পরীক্ষা বটে। কিন্তু অনেক পরীক্ষার মতোই শেষ অবধি এতেও ভারতীয় ব্যবস্থা নিজের শক্তির পরিচয় দেবে, এটাই প্রত্যাশিত।