ফাইল চিত্র।
এক বাংলা সিনেমায় বিচারের দৃশ্যে বেকসুর খালাস পাইবার মুহূর্তে ছবি বিশ্বাস-অভিনীত চরিত্রটি বলিয়াছিল, “আমার বারোটা বছর ফিরিয়ে দাও।” পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি তেমন হাহাকার করিয়া উঠিল না নেহাত কথা বলিতে পারে না বলিয়াই। পার্থবাবু জানাইয়াছেন যে, টাটা গোষ্ঠীর সহিত তাঁহাদের কোনও বিরোধ নাই; সিঙ্গুর-কাণ্ডের জন্য তাঁহারা টাটা গোষ্ঠীকে দোষীও ভাবেন না। দোষ তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের— তাহাদের গা-জোয়ারি হইতেই সমস্যার সূত্রপাত। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের অবিমৃশ্যকারিতার কথাটি যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় নেহাত ভুল বলিয়াছেন, তেমন দাবি করা মুশকিল। সত্য, ‘আমরা ২৩৫, ওরা ৩০’-এর দম্ভে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়াছিলেন। রাজ্যের মানুষ যে সেই ঔদ্ধত্যকে ভাল চোখে দেখেন নাই, তাহার প্রমাণ এই বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলেও আছে। এই নির্বাচনের পূর্বে সিপিএম-এর কর্মী-সমর্থকরা কখনও ফিসফিস করিয়া, আবার কখনও বজ্রনির্ঘোষে বলিতেছিলেন যে, সিঙ্গুরে বুদ্ধদেববাবু তিলমাত্র ভুল করেন নাই— অস্যার্থ, রাজ্যবাসী তাঁহাকে বুঝিতে ভুল করিয়াছে। প্রচারের ফল, বামফ্রন্টের সাত শতাংশ ভোটব্যাঙ্কেও ক্ষয় ধরিল। তৎকালীন সরকারের ভুল লইয়া রাজ্যবাসীর মনে সংশয় ছিল না, এখনও নাই।
কিন্তু, ভুল কি শুধু সরকারেরই ছিল? বিরোধীপক্ষেরও কি ছিল না? তৎকালীন সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতি বিস্মৃত হইয়া গায়ের জোরে জমি আদায় করিতে নামিয়াছিল। গণতন্ত্রের স্বার্থেই তাহার প্রতিরোধ হওয়া জরুরি ছিল— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রতিরোধ করিয়াছিলেন। অস্বীকার করিবার উপায় নাই যে, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলনই তাঁহার রাজ্যজয় নিশ্চিত করিয়াছিল। কিন্তু, সেই আন্দোলন যে অগণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে, রাজ্যে শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে নহে— এই কথাটি তিনি কখনও স্পষ্ট ভাবে বুঝান নাই। পার্থবাবু আজ যেমন বলিতেছেন যে, তাঁহাদের লড়াই টাটা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ছিল না— এই কথাটি তাঁহারা সেই দিন বলেন নাই। তাঁহারা জমি লইতে দিবেন না, এই কথাটি বলিয়াছিলেন, কিন্তু জমি অধিগ্রহণের বিকল্প পন্থা বিষয়ে আলোচনার কথা বলেন নাই। অর্থাৎ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার গোটা পথ তাঁহারাও চলেন নাই। তাঁহারা অগণতান্ত্রিকতায় বাধা দিয়াছেন; বহু মানুষকে লইয়া আন্দোলন গড়িয়া তুলিয়াছেন; সর্বোপরি, সরকারের ঔদ্ধত্যে যে মানুষগুলির কণ্ঠরোধ হইতেছিল, তাঁহাদের কথা বলিয়াছেন— কিন্তু, ইহাই তো সব নহে। শাসকপক্ষের ভুলটি চিহ্নিত করিবার পর সংশোধনের পথ করিয়া দেওয়াও বিরোধীদেরই কাজ। কোন পথে আগাইলে রাজ্যে সত্যই শিল্পায়ন ঘটিতে পারে, বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস তৎকালীন শাসকপক্ষকে সেই আলোচনায় টানিতে পারে নাই।
শিল্পায়নের প্রশ্নে রাজ্যের শাসক ও বিরোধী, উভয় পক্ষই একজোট হইয়া লড়িবে, ইহা নেহাতই সুখকল্পনা নহে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই ঘটনাটি এতই নিয়মিত ঘটে যে, তাহাকে কেহ আর আলাদা ভাবে খেয়ালও করেন না। উদাহরণস্বরূপ তামিলনাড়ুর কথা বলা চলে। যুযুধান এডিএমকে এবং ডিএমকে কিন্তু রাজ্যে গাড়ি নির্মাণ শিল্প গড়িবার কাজে নিজেদের রাজনৈতিক বিরোধকে টানিয়া আনে নাই। এবং, বিরোধীপক্ষ শিল্পায়নে সহায়তা করায় পরবর্তী নির্বাচনে তাঁহাদের ভোট পাইতেও সমস্যা হয় নাই। কিসে রাজ্যের লাভ, আর কিসে ক্ষতি, সাধারণ মানুষ বিলক্ষণ বোঝেন। নেতারাও যদি বুঝিতে আরম্ভ করেন তো মঙ্গল। যে ডালে অধিষ্ঠান, তাহাকেই কাটিবার বিলাসিতাটি কালীদাসের কালেও বিপজ্জনক ছিল। আর, এখন তো ঘোর কলি।