ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, আপনার দিন গিয়েছে। নচেৎ জানতেন, যা ‘দেখিলেও না হয় প্রত্যয়’, রাজনীতির কারবারিরা তার নিত্যব্যবসায়ী। যেমন, বিজেপির আইটি সেলের কর্ণধার অমিত মালবীয়। শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস এবং সিকিয়োরিটিজ় অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন দুর্নীতির অভিযোগ আনামাত্র শ্রীমালবীয় ভারতীয় সাংবাদিক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া অবধি তাঁকে নির্দোষ বিবেচনা করাই বিধেয়। কথাটি এমনিতে আঠারো আনা সত্য— ভারতীয় বিচারব্যবস্থার একেবারে প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে এই দর্শনটি। সমস্যা হল, মালবীয়দের মুখে সেই কথাটি শুনলে চমকে-চমকে উঠতে হয়। কারণ, অভিযোগের তির প্রধানমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীপ্রবরের দিকে ঘোরার আগে অবধি তাঁদের দেখে কখনও সংশয় হয়নি যে, তাঁরাও এই কথাটি জানেন, বা জানতে পারেন। জেলের দেওয়াল ভেদ করে অমিত মালবীয়র কথাটি জেএনইউ-এর ছাত্রনেতা উমর খালিদের কান অবধি পৌঁছলে তিনি শত যন্ত্রণার মধ্যেও সম্ভবত আমোদিত হবেন। তাঁকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করতে বিজেপির কোনও প্রমাণের প্রয়োজন পড়েনি। নিজেরা অভিযোগ করে তাকেই ধ্রুব সত্য জ্ঞান করেছে— আদালতে শাস্তি না-হলেও কয়েদখানায় আটকে রেখে যথেষ্ট শাস্তিরও ব্যবস্থা করা গিয়েছে।
উমর খালিদ একা নন, বিজেপির রাজত্বে এটাই দস্তুর— স্ট্যান স্বামী বা জি এন সাইবাবা, সোমা সেন অথবা গৌতম নভলখা, কোবাড গান্ধীর মতো নামের তালিকা সহজে ফুরোনোর নয়। সমাজকর্মী থেকে সাংবাদিক, শিক্ষাজীবী— এই গৈরিক জাতীয়তাবাদী জমানায় যিনিই সরকারকে প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছেন, তাঁকেই অপরাধী সাব্যস্ত করেছে ক্ষমতাতন্ত্র। অমিত মালবীয় বা তাঁদের দলের অন্য কোনও নেতাকে দেখে তখন এক বারও সন্দেহ হয়নি যে, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া অবধি অপেক্ষা করার কথাটিতে তাঁরা বিশ্বাস করেন। অবশ্য, গৈরিক জাতীয়তাবাদী শিবিরের সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে থাকা নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই একটি জায়গায় একেবারে এক রকম— আর জি কর-কাণ্ডে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ডাক্তারকে ‘অভিযুক্ত’ বলায় তিনি বলেছিলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেই তাঁকে অভিযুক্ত বলা যায় না! গুছিয়ে কথা বলার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর তেমন খ্যাতি নেই, ফলে ধরে নেওয়া যায়, তিনি বলতে চেয়েছিলেন যে, অভিযুক্ত হলেই কেউ অপরাধী প্রমাণ হয় না। অর্থাৎ, এই কথাটি তিনিও জানেন। কিন্তু, যত দিন অবধি অভিযোগের আঙুলটি অন্যদের দিকে উঠেছে— রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে তিনি নিজেই বহু বার আঙুল তুলেছেন— তত দিন অবধি অভিযুক্তের এই রক্ষাকবচের অধিকারের কথা তাঁরও খেয়াল হয়নি।
অমিত মালবীয়দের অবশ্য একটি কৃতিত্ব দিতেই হবে— রাজনৈতিক নেতাদের দ্বিচারিতা, নৈতিকতাবিবর্জিত পক্ষপাতদুষ্টতাকে তাঁরা কথার ছলে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংবিধান যা-ই বলুক না কেন, তাঁদের ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান আছে— তাঁদের কাছে সব নাগরিক কোনও মতেই সমান নন। গৌতম আদানি ও উমর খলিদের মধ্যে তাঁরা পার্থক্য করতে জানেন। কেউ বলতে পারেন, প্রধানমন্ত্রীর সাঙাততন্ত্রের মধ্যমণির দিকে যে এমন অভিযোগ ধেয়ে আসতে পারে, সেটাই অকল্পনীয় ছিল— ইতিপূর্বে কোনও অভিযোগই সরকারের রক্ষাকবচ ভেদ করে আদানিকে ছুঁতে পারেনি, এমনকি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টও নয়। অমিত মালবীয়রা সম্ভবত উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা পড়েননি, নয়তো জানতেন, তিমিঙ্গিল সত্যিই আছে— এবং, সে যখন তিমিকে গিলে ফেলে, তখন বহুলাঞ্ছিত সংবিধানের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দেখা যাচ্ছে, চক্ষুলজ্জার বালাই না থাকলে সে কাজটি নির্দ্বিধায় করেও ফেলা যায়।