ফাইল চিত্র।
অমিত শাহ এই বার খিড়কি বেছেছেন। অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির উপর হিন্দি ভাষাকে সরাসরি চাপিয়ে দেওয়া নয়, এই বার তিনি প্রস্তাব করেছেন, ইংরেজির বদলে দেশের বিভিন্ন অ-হিন্দিভাষী রাজ্যের মানুষ নিজেদের মধ্যে হিন্দিতে কথা বলুন। প্রস্তাবটির মধ্যে প্রত্যক্ষ গা-জোয়ারি নেই, বরং কৌশল আছে। সেই কারণেই এই প্রস্তাব সম্বন্ধে আরও বেশি সচেতন হওয়া বিধেয়। তিনি সরকারি ভাষা বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান— সেই কমিটির বৈঠকেই প্রস্তাবটি পেশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থাৎ, এ নিছক কথার কথা নয়, সুচিন্তিত অবস্থান। একটি সাধারণ মঞ্চ থেকে কোনও সাধারণ লোক এই কথাগুলি বললে তার গুরুত্ব যতখানি হত, দেশের সর্বোচ্চ কমিটির প্রধান সেই কমিটির বৈঠকে একই কথা বললে তার গুরুত্ব বহু গুণ বেশি। অমিত শাহের মন্তব্যের কয়েকটি স্তর আছে। প্রথম স্তর হল, ইংরেজি ভাষাকে বর্জন করা। তাঁর ভাবটি এমন, যেন ইংরেজি ভারতীয় ভাষা নয়। সংবিধান ইংরেজিকে ভারতের ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে— হিন্দি বা অন্য কোনও ভাষার সঙ্গে ইংরেজির কোনও বিরোধ নেই। এই না-থাকা বিরোধ জাগিয়ে তোলা যে বিজেপির রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ, এত দিনে এই কথাটি স্পষ্ট। এবং, অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এই ভাষার বিরোধেও বিজেপির অবস্থানটি গোবলয়ের হিন্দিভাষী জনগোষ্ঠীর পক্ষে সুবিধাজনক। অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে এমনকি বিজেপির সহযোগী দলগুলিও যে অমিত শাহের এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে, তা অকারণে নয়।
ভাষা হিসাবে হিন্দি গুরুত্বহীন, এমন দাবি করার প্রশ্ন নেই। সেই ভাষার বিকাশ ঘটলেও তাতে কেউ আপত্তি জানাবেন না। কিন্তু, যে দেশ ঐতিহাসিক ভাবে বহুভাষী, তার উপর কোনও কৌশলেই হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি, পারস্পরিক সংযোগের ভাষা হিসাবে ব্যবহারের আপাত-নিরীহ পরামর্শের মাধ্যমেও নয়। দেশের মানুষ কোন ভাষায় কথা বলবেন, দুই ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পরস্পরের সঙ্গে কথা বলবেন কোন ভাষায়— সেই সিদ্ধান্ত একান্ত ভাবেই তাঁদের। তা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে অমিত শাহের কর্তব্য ছিল এই বহুত্বকে সম্মান করা। তিনি বলেছেন, হিন্দি ভাষাকে নমনীয়, গ্রহণশীল হতে হবে— আঞ্চলিক ভাষার শব্দ গ্রহণ করতে হবে। ভাষা বস্তুটি সততই চলমান, জৈব। যে কোনও ভাষাই গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে— তার জন্য সরকারি ফরমানের প্রয়োজন পড়ে না। গ্রহণশীলতা অতি উত্তম ধর্ম— বিজেপির নেতারা বরং তা অভ্যাস করতে পারেন। তা হলে দেশের বহুত্বকে তাঁদের এতখানি অসহ্য ঠেকবে না।
অমিত শাহের প্রস্তাবটি এক দিকে নাগপুরের একশৈলিক আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ, অন্য দিকে তিনি দলের হিন্দিভাষী ভোটারদেরও আশ্বস্ত করছেন যে, ইংরেজি রপ্ত করার প্রয়োজনীয়তাই আর থাকবে না। কিন্তু এই রাজনীতি আসলে দেশের তরুণ সমাজের এক মস্ত ক্ষতি করতে পারে। ইংরেজি ভাষাটি বর্তমান বিশ্বে অনন্য— আর কোনও ভাষা এমন ভাবে বৈশ্বিক হতে পারেনি। ফলে, আন্তর্জাতিক কাজের বাজারে নিজেদের জায়গা করে নিতে চাইলে এই ভাষাটিকে পরিহার করা অসম্ভব। বস্তুত, ইংরেজিতে দখল থাকার কারণেই বিশ্বায়ন-পরবর্তী পর্যায়ে ভারত পরিষেবা ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠতে পেরেছিল। জার্মানি থেকে চিন, নিজেদের ভাষা নিয়ে অতীব গর্বিত বহু দেশও ইংরেজির এই গুরুত্ব অনুধাবন করেছে, এবং সেই ভাষার শিক্ষার উপর জোর দিয়েছে। ইংরেজি ভাষাকে ভালবেসে নয়, একান্তই নিজেদের স্বার্থে। সঙ্কীর্ণ রাজনীতির কথা ভেবে ভারতকে ভিন্ন পথে চালনা করার বাসনাটি দেশের তরুণদের স্বার্থরক্ষা করবে না।