কেন্দ্রীয় সরকার যাহা পারে নাই, পশ্চিমবঙ্গ সেই পথেই হাঁটিতে প্রয়াস করিল। মানুষের হাতে নগদ টাকা তুলিয়া দিবার পথ, সরকারের খরচ বাড়াইবার পথ। এককথায় ইহাই এই বৎসরের রাজ্য বাজেট। গত এক-দেড় বৎসরে পথটি লইয়া বহু চর্চা হইয়াছে; দেশ-বিদেশের অর্থশাস্ত্রীরা এই কেনসীয় ব্যবস্থাপত্র মানিয়া চলিবার পরামর্শ দিয়াছেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাহাতে কর্ণপাত করে নাই। অতিমারি-বিধ্বস্ত অর্থব্যবস্থাকে চাঙ্গা করিতে অর্থমন্ত্রী গত বৎসরও বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করিয়াছিলেন, এই বৎসরও করিয়াছেন— কিন্তু, কোনওটিতেই মানুষের হাতে টাকা তুলিয়া দেওয়ার বন্দোবস্ত নাই। ফলে, গত বৎসরের প্যাকেজ যেমন ব্যর্থ হইয়াছে, এই বৎসরের প্যাকেজেরও সেই পরিণতিই হইবে বলিয়া আশঙ্কা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের বাজেটকে আরও ব্যতিক্রমী বোধ হইতে পারে।
এক্ষণে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। এক, যেখানে গোটা দেশ আর্থিক মন্দায় আক্রান্ত, সেখানে একটি রাজ্যের চেষ্টা কি সফল হইতে পারে? রাজ্য সরকারের এই ব্যয়বরাদ্দে সর্বভারতীয় অর্থব্যবস্থার হাল যে ফিরিবে না, তাহা বলা বাহুল্য। পশ্চিমবঙ্গেও এই ব্যয় আর্থিক বৃদ্ধির হারকে খানিক গতিশীল করিবে— কিন্তু সর্বভারতীয় শ্লথতা রাজ্যকেও পিছনে টানিবে। প্রশ্ন শুধু আয়বৃদ্ধির নহে, মানুষের জীবন-মরণের। সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাইলে অনেকের দুই বেলা অন্নের সংস্থান হইবে; অনেকে পায়ের নীচে মাটি পাইবেন। তাহার গুরুত্ব অপরিসীম। দ্বিতীয় প্রশ্ন, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যয়বৃদ্ধির পথে হাঁটিতে নারাজ, সেখানে একটি রাজ্যের পক্ষে কি সেই পথে হাঁটা সম্ভব, বা উচিত? পূর্বের আলোচনা হইতেই স্পষ্ট যে, এই সিদ্ধান্তের ঔচিত্য প্রশ্নাতীত। তাহা কতখানি সম্ভব, সেই প্রশ্নের উত্তর রাজ্যের শীর্ষকর্তাদের খুঁজিতে হইবে। যেখানে টাকার অভাব তীব্র, সেখানে মানুষের হাতে নগদের সংস্থান করিবার নীতির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের ব্যবস্থা তাঁহারা কী ভাবে করিবেন, কোন খাতে খরচে কাটছাঁট করিবেন, এবং এই নীতির ফলে সার্বিক ভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কী প্রভাব পড়িবে, তাহা স্পষ্ট ভাবে জানা ও জানানো প্রয়োজন। তৃতীয় প্রশ্ন, খরচের টাকা আসিবে কোথা হইতে? রাজ্য সরকার যে হিসাব পেশ করিয়াছে, তাহাতে যেমন কররাজস্ব বৃদ্ধির আশা আছে, তেমনই কেন্দ্র হইতে প্রাপ্য অর্থের পরিমাণও গত অর্থবর্ষের তুলনায় তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি। তবে, তাহাতেও সব প্রয়োজন মিটিবে না। রাজ্যের কর্তারা জানাইয়াছেন, প্রয়োজনে ঋণ করা হইবে। আর্থিক মন্দার মোকাবিলায় ঋণ করিবার ছাড়পত্র কেন্দ্রীয় সরকার দিয়া রাখিয়াছে, ফলে রাজ্য তাহার এক্তিয়ারে থাকিয়াই ঋণ করিতে পারিবে, সরকারি সূত্রের এমনই মত।
রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখিবার অনেক সুফল; কিন্তু এই অ-স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে যে প্রয়োজন হইলে ঋণ করিতে হইবে, তাহাও ঠিক। অর্থশাস্ত্রের তেমনই নির্দেশ। কিন্তু, একই সঙ্গে এই কথাটিও স্মরণে রাখা জরুরি যে, এই রাজ্যের ঋণের সমস্যা ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাইতেছে। হিসাব বলিতেছে যে, আগামী অর্থবর্ষে রাজ্যের পুঞ্জীভূত ঋণের বোঝা প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়াইতে পারে। এই বোঝার একটি অংশ যে বামফ্রন্ট আমলের উত্তরাধিকার, তাহা অনস্বীকার্য। ঋণের বোঝা বাড়িয়াই চলে, তেমনই তাহার ধর্ম। ফলে, এই দিকে নজর দেওয়া দরকার। কেন্দ্রের নিকট যেমন ছাড়ের দাবি করিতে হইবে, তেমনই নূতন ঋণের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়াও বিধেয়। কোন খরচটি না করিলেও চলে, আর ধার করিয়া হইলেও কোন খরচটি করিতেই হইবে, সরকারের এই বিবেচনার উপরই রাজ্যের আর্থিক ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভরশীল।