ছবি: সংগৃহীত।
যুগান্তকারী শব্দটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ, তবু আঙ্কল টম’স কেবিন উপন্যাস সম্পর্কে ওই বিশেষণ সুপ্রযুক্ত। ১৭০ বছর আগে প্রকাশিত ওই উপন্যাসে হ্যারিয়েট বিচার স্টো ক্রীতদাসরা কতটা অত্যাচারিত, তার মর্মস্পর্শী কাহিনি তুলে ধরেন। আঙ্কল টম’স কেবিন প্রকাশের পর দাসপ্রথা বিলোপের পক্ষে সমর্থন বাড়ে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন অভিনন্দন জানান লেখিকা স্টো-কে। অভিঘাতে আঙ্কল টম’স কেবিন-এর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে আর একটি বইয়ের। এটিরও লেখিকা এক মহিলা। রেচেল লুইস কারসন। তাঁর লেখা সাইলেন্ট স্প্রিং প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। বই হিসাবে এর প্রকাশ সেপ্টেম্বর মাসে। তার আগে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজ়িন ছাপে বইয়ের অংশবিশেষ, জুন মাসে। সে হিসেবে আসন্ন জুন মাসে এই বইয়ের হীরক জয়ন্তী বর্ষপূর্তি। ৬০ বছর আগে প্রকাশিত ওই বইয়ের আমাদের জীবনে অভিঘাত সম্পর্কে আলোচনা জরুরি। যে পত্রিকা ১৯৪৬ সালে জাপানের হিরোশিমা শহরে অ্যাটম বোমা বিস্ফোরণজনিত ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন প্রকাশ করে মানুষকে ওই অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করেছিল, সেই পত্রিকাই আবার ১৯৬২ সালে সাইলেন্ট স্প্রিং বইয়ের অংশবিশেষ প্রথম প্রকাশ করে মানুষকে পরিবেশের আশু বিপদ সম্পর্কে জানান দিয়েছিল। সাংবাদিকতার উপজীব্য যে শুধু মনোরঞ্জন নয়, সমাজ-সচেতন করে তোলাও, তা অবশ্য আজকাল বিস্মৃতির পথে। ।
সাইলেন্ট স্প্রিং গ্রন্থে লেখিকা এক মূক বসন্তের ছবি আঁকেন। বসন্ত পাখির কলতানে মুখরিত। তা মূক কেন? কারসন দেখান, কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে জীববৈচিত্র ক্ষীয়মাণ। ক্ষতিগ্রস্ত পাখিকুল, যারা বসন্ত ঋতুতে মুখর। বইটি প্রকাশের পর শুরু হয় পরিবেশ চিন্তা, যা ইদানীং কালে এক আন্দোলনে পর্যবসিত। এর দশ বছর পরে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় আমেরিকান সরকারের এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি (ইপিএ)। এখন ওই সংস্থার ছাড়পত্র বিনা কোনও খাদ্যদ্রব্য অথবা ওষুধ বাজারে আসে না। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি), যা গঠিত হয় ১৯৮৮ সালে, তাকে ওই সাইলেন্ট স্প্রিং বইয়ের সুদূরপ্রসারী পরিণাম আখ্যা দেওয়া যায়। পরিবেশ আন্দোলনে রাজনীতি এবং রাষ্ট্র ঢুকে গিয়ে অগ্রগতি ব্যাহত করছে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যতখানি পরিবেশবান্ধব ছিলেন, জর্জ ডব্লিউ বুশ ততখানি ছিলেন না। কারসনের দুঃস্বপ্ন তাই মেটেনি, পরিবেশ এখনও মানবজাতির পয়লা নম্বর শত্রু। ২০১৯ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষী-বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কেনেথ রোজ়েনবার্গ-এর এক সমীক্ষা অনুযায়ী, উত্তর আমেরিকা মহাদেশের ২৯ শতাংশ পাখি ১৯৭০ সালের তুলনায় অবলুপ্ত। ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিইএস)-এর হিসাব অনুযায়ী, ৪০ শতাংশের বেশি উভচর প্রাণী বিপদাপন্ন। অডোবন সোসাইটির এক রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের একমাত্র উপায় রাষ্ট্রনায়কদের সহযোগিতা। সাইলেন্ট স্প্রিং বইতে কারসন লিখেছিলেন, কীটনাশকগুলির মধ্যে জীববৈচিত্রের প্রধান শত্রু ডাইক্লোরো-ডাইফিনাইল-ট্রাইক্লোরোইথেন (ডিডিটি)। মূলত ওই বইতে চিহ্নিতকরণের পর ডিডিটি-র উৎপাদন বন্ধ হয়েছে।
ডিডিটি আবিষ্কৃত হয় ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে। অস্ট্রিয়ার রসায়নবিদ ওথমার জিডলার তা আবিষ্কার করেন। সুইৎজ়ারল্যান্ডের রসায়নবিদ পল হেরমান মুলার ওই দ্রব্যের এক বিচিত্র গুণ ১৯৩৯ সালে আবিষ্কার করেন। ডিডিটি বিভিন্ন কীটকে মেরে ফেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে নানা কীটবাহিত রোগ— যেমন, ম্যালেরিয়া এবং টাইফাস— যখন নানা দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে ছড়ায়, তখন তা প্রশমনে ডিডিটি ব্যবহার করা হয়। ১৯৪৮ সালে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হয় মুলারকে। যে রাসায়নিকের কার্যকারিতা দেখে নোবেল পুরস্কার, তা কিনা পরিবেশের শত্রু! বিজ্ঞান চিত্তাকর্ষক এ কারণে যে, এতে শেষ কথা কখনও বলা যায় না। অথবা, কীটনাশক হিসাবে ডিডিটি-র কার্যকারিতা এত বড় আবিষ্কার যে, তাকে নোবেল প্রাইজ় দিতেই হত। এ যেন পরমাণু বিভাজনের মতো ব্যাপার, যে বিভাজন অ্যাটম বোমার মূল নীতি। অথচ, হিরোশিমা-নাগাসাকির মতো ঘটনার পরও জার্মান রসায়নবিদ অটো হানকে নোবেল প্রাইজ় দেওয়া হল পরমাণু বিভাজন প্রক্রিয়ার সাফল্যের জন্য।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।