ফাইল চিত্র।
দুই বৎসরে এই প্রথম: গত বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরের নেতাদের সহিত বৈঠকে বসিলেন। সংবিধানের ৩৭০ ধারা-মতে কাশ্মীরের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল, দুই বৎসর পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাহার অবসান ঘটিয়াছিল। পাশাপাশি, দুই বৎসরে এই প্রথম: রবিবার কাশ্মীরে বড় মাপের ড্রোন হানা ঘটিল। ঘটনা দুইটিকে হয়তো বিচ্ছিন্ন বলা যাইবে না। কাশ্মীরে উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক বৈঠক ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হানা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গোলযোগ চির কালই হাত ধরিয়া পাশাপাশি চলিয়াছে। যখনই ভারতের সহিত পাকিস্তানের, কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ বিষয়ে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা হইয়াছে, তখনই অতর্কিত ভাবে কাঁপিয়া উঠিয়াছে উপত্যকা, দাম দিয়াছেন উপত্যকার বিপন্ন সাধারণ মানুষ। নকশাটি এত দিনে সুপরিচিত। এই ভাবেই হয়তো কাশ্মীরি মানুষের নিরাপত্তা বার বার বিনষ্ট হইবে, ভারতীয় রাষ্ট্রের সার্বভৌমতার দাবি বার বার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িবে। কেহ বা কাহারা আক্রমণের দায় স্বীকার করিয়া লইবেন, অথচ নেপথ্যের প্রকৃত ‘খেলোয়াড়’রা প্রচ্ছন্নই থাকিয়া যাইবেন। ভারত ও পাকিস্তানের সরকার তদন্তে নামিবে, অথবা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিবে, ও দিকে গোয়েন্দা-জঙ্গি-বিচ্ছিন্নতাবাদীর দুষ্টচক্র যেমন বহাল তবিয়তে ছিল, তেমনই থাকিবে। ইহা যেন স্থায়ী নকশা— ক্ষয়ও নাই, লয়ও নাই।
নকশাটি অপরিবর্তিত রহিলেও, জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যটির চেহারায় আশু পরিবর্তনের সাক্ষাৎ ইঙ্গিত এ বারের বৈঠকে। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হইতে আবার রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়া পাইবে জম্মু ও কাশ্মীর, এমন আশ্বাস মিলিল। তবে কি না, সেই নূতন রাজ্যের চরিত্র যে অনেক আলাদা হইবে, তাহাও আকারে ইঙ্গিতে ধ্বনিত হইল। জানা গেল, লাদাখকে এখনকার মতো কেন্দ্রশাসিত রাখিয়া ভবিষ্যৎ রাজ্যটির বাকি অংশে নূতন অভ্যন্তরীণ সীমানির্ধারণ (ডিলিমিটেশন) হইবে। এ বিষয়ে আঞ্চলিক নেতারা নিজেদের মত জানাইলেও তাহাতে বিশেষ কর্ণপাত করিবার প্রয়াস হইল না। ওমর আবদুল্লার তীক্ষ্ণ প্রশ্ন: সব রাজ্য ছাড়িয়া এখানেই কেন তড়িঘড়ি ডিলিমিটেশন-এর ব্যবস্থা— তাহার উত্তর প্রকাশ্য করা সহজ নহে। উত্তরটি সম্ভবত ইহাই যে— এই পদ্ধতিতে রাজ্যের সম্প্রদায়-চরিত্র অনেকাংশে পাল্টাইয়া যাইবে। কখন কোন সরকারি নীতি কী ভাবে কোথায় প্রয়োগ করা হইতেছে, তাহা স্থির করা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ক্ষেত্রে কেন্দ্রেরই একচেটিয়া অধিকার: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপে তাহা ইতিমধ্যেই প্রাঞ্জল। সুতরাং কাশ্মীরের নেতাদের প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঊহ্যই রহিল।
দিল্লির দিক হইতে অঞ্চল ও আঞ্চলিক নেতাদের অগ্রাহ্য করিয়া চলিবার অভ্যাসটি মোদীর আমলে অনেক গুণ শক্তপোক্ত হইয়াছে। অথচ এই অভ্যাসের বিষম ফলের সহিত উপত্যকার সন্ত্রাসী হানাহানির যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সেই সত্য তাঁহারা মানিতে নারাজ। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা লোপের পর কেন্দ্রীয় নির্দেশে সেখানে গত দুই বৎসরব্যাপী এক অসহনীয় ‘লকডাউন’ পর্ব চলিয়াছে। আঞ্চলিক নেতারা বারংবার প্রতিবাদ করিয়াও কোনও প্রতিকার পান নাই। সামরিক বাহিনী উপত্যকার নাগরিক ও জঙ্গির মধ্যে ভেদাভেদ না করিয়া চরম নিষ্পেষণ চালাইয়াছে। ফল হইয়াছে বিষম। নির্যাতিত বোধ করিয়া কাশ্মীরি জনসাধারণ দিল্লি ও ভারতের উপর বীতশ্রদ্ধ; অভিজ্ঞ জনের মতে, তাঁহাদের অনেকেই এখন বিচ্ছিন্নতাবাদী, এমনকি জঙ্গিদের আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিতে আগ্রহী। এই অতীব বিপজ্জনক পরিস্থিতি কেবল বলপূর্বক শাসনের দ্বারা বাগে আনার দুরাশা করিতেছেন মোদী ও শাহ। সুতরাং, অসহযোগী অতিশাসন ও সহিংস আক্রমণের এই ধারা চক্রবৎ চলিবে— এমনটাই ধরিয়া রাখা যায়।