ছবি: সংগৃহীত
আমার মায়ের কাকা, যাঁকে আমরা ছোটদাদু বলতাম, তিনি ছিলেন আমাদের শৈশবের গল্পদাদুও। তাঁর ঝুলি বোঝাই ছিল অনেক লোককথা আর নিজের ডানপিটে ছোটবেলার অফুরন্ত কাহিনি। সবই পূর্ববঙ্গের। অর্ধেক জীবন কুমিল্লায় কাটানো প্রায় নিরক্ষর মানুষটির কুমিল্লার ডায়ালেক্টে বলার ভঙ্গিমায় ঘটনা ও চরিত্রগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠত। তবে সব চেয়ে জীবন্ত আর রুদ্ধশ্বাস ছিল তাঁর দেশ-গাঁ-ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের কাহিনি। যা বলতে বলতে বহুকাল পরেও তাঁর শরীরে, চোখেমুখে প্রচণ্ড আতঙ্ক-ভয়-ক্রোধ ফুটে উঠত। সদা উৎফুল্ল শক্ত চেহারার মানুষটি প্রায়শ শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়তেন।
সাম্প্রতিক কালের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেখে সেই ভয়াবহতার খানিকটা অনুভব করতে পারি। খুব ছোট থেকে চেতনা অসার করে দেওয়া এই গল্পই তো শুনে এসেছি ছোটদাদুর মতো আত্মীয়-পরিজন কিংবা বাবা-কাকা-মায়েদের মুখে। দেশ ছেড়ে, মাটি ছেড়ে, সংস্কৃতি ছেড়ে, ঘর-সংসার-সম্পদ-জীবিকা ছেড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলেছে মৃত্যু, অনাহার, হিংসা-রিরংসার ঘনঘোর অনিশ্চিত অসহায় ভবিষ্যের দিকে। খোলামকুচির মতো মানুষ উপচে পড়ছে দূরগামী পথে পথে, স্টিমারে-নৌকোয়, রেলের গাড়িতে, স্টেশনের প্লাটফর্মে।
অচেনা অজানা বিভূঁইয়ে বনজঙ্গল কেটে দাদা-ভাই-মা-বোনেদের সঙ্গে নতুন বসত আর পেটের দানাপানি খুঁজতে খুঁজতেই শৈশব-কৈশোর কাটিয়ে দিয়েছিলেন, একদা দিল্লিবাসী উচ্চপদের চাকুরে অকালপ্রয়াত পিতার সন্তান, পরবর্তী কালে দেশভাগের উদ্বাস্তু আমার বাবা। কর্মজীবনে শিক্ষক হয়ে কী ভাবে ছাত্রদের কাছে দেশের তথাকথিত জাতীয়তাবাদ কিংবা স্বাধীনতা লাভের মহানুভবের কথা শুনিয়েছেন— ভেবে অবাক হয়েছি। ধীরে ধীরে বুঝেছিলাম, আসলে আজীবন বাবা মনের গভীরে, এই দেশে বহিরাগতই থেকে গিয়েছিলেন। হয়তো বা ছিল ‘বাঙাল’এর হীনম্মন্যতাও। স্মৃতির ভিতরে চির দিন লালন করেছেন অন্য এক ‘দেশের বাড়ি’।
বহিরঙ্গে তাই হয়তো নিজেকে এই দেশের মানুষ বোঝানোর তাগিদটা বড় হয়ে উঠেছিল।
আমার বাবার ‘বহিরাগত’ বোধের ভিতরে কোথাও কি নিরাপত্তার অভাববোধও মিলেমিশে ছিল? থেকে থাকলে তা যে খুব অমূলক ছিল না। তা তো এই স্বাধীনতার বাহাত্তর বছর পরে ভীষণ ভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে। দেশভাগ আবারও তাড়া করেছে বাঙালিকে। বিশেষ করে, শরণার্থী বাঙালিকে। মহারাষ্ট্রে, মধ্যপ্রদেশে, বিহারে বহু কাল আগেই দেখেছি আমি স্থানীয়দের কাছে এঁরা বরাবরের আপদ। মরিচঝাঁপির কথা নতুন করে বলার নেই। এ রাজ্যের তথাকথিত বাম সরকারের সেই উদ্বাস্তু উদ্যমী মানুষগুলোর প্রতি সংগঠিত নৃশংসতা আজও শিহরিত করে। অসমও কম ‘বাঙালিখেদা’ দেখেনি। বাংলা ভাষার স্বীকৃতির লড়াইয়ে সরকারি উদ্যোগে পুলিশের গুলি খেয়ে মরেছে মানুষ।
দেশভাগের অনিবার্য ফল হিসেবে পূর্ববঙ্গের অনেক নিঃসহায় বাঙালি অসম রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন সত্যি, কিন্তু বরাক উপত্যকায়, কাছাড়ে বসবাসকারী বহু বাঙালি, যাঁরা আদতে ছিলেন অবিভক্ত বাংলা তথা ভারতেরই মানুষ, তাঁদেরও বহিরাগত বলে দেগে দিয়ে এক শ্রেণির অসমিয়া নেতারা সরকারি প্রশ্রয়ে অপপ্রচার, দাঙ্গা, গণহত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক ফয়দা উসুল করেছেন। অসম সরকারের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী তো ঘোষণাই করেছিলেন— ‘অসম শুধু অসমিয়ার’। কফিনে শেষ পেরেকটি মেরেছিল রাজীব গাঁধীর অসম চুক্তি। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়েছে সেখানে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো, বাঙালি ছেলেমেয়েদের চাকরির ক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়েছে। অথচ, গোটা ভারত জুড়েই সার্থক ভাবে প্রচার করে করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে অসম রাজ্যটিকে বাঙালি তথা বাংলাদেশিরা দখল করে নিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পঞ্জিকরণ (এনআরসি)-এর আগে অসমের হিন্দু সম্প্রদায়ের বাঙালিরা ভেবেছিলেন, কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতাশীন বিজেপি সরকারের বদান্যতায় তাঁরা পার পেয়ে যাবেন, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন মুসলমানেরা। কিন্তু খসড়াপঞ্জি এবং পরবর্তী চূড়ান্ত তালিকা তাঁদের সুখকল্পনার সে-গুড়ে বালি ঢেলে দিয়েছে। ১৯ লক্ষ বাদ পড়া মানুষের মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষই হিন্দু। এমন অবস্থায় সংসদে সংখ্যার জোরে পাশ হয়ে এল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। বোঝানো হল, নতুন এই আইনের ফলে হিন্দুরা ‘শরণার্থী’ হিসাবে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন কিন্তু বহিরাগত মুসলমানরা সেই সুবিধা পাবেন না।
কেন পাবেন না, সে বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা এত দিনে অনেকেই জেনে গিয়েছেন। এই আইন পরিষ্কার ভাবে ভারতীয় সংবিধানের সাম্যের অধিকারকে খর্ব করে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতীয় নাগরিকদের বিভাজনের রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় মান্যতা দিয়েছে।
তা সত্ত্বেও এই আইন শেষ পর্যন্ত অসমের হিন্দু ভোটারদের, বিশেষ করে বাংলাভাষী হিন্দুদের পক্ষে আদৌ স্বস্তিদায়ক নয়। কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অসমিয়াকেই সে রাজ্যের এক মাত্র রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে এবং এমন একটি আইনের কথাও বলা হচ্ছে, যাতে অসমিয়া ছাড়া আর কেউ ওই রাজ্যে জমি কিনতে না পারেন। তবু এই নতুন নাগরিকত্ব আইনের কারণে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠেছেন অসমের জনতা ও নেতা-নেত্রীরা। বিক্ষোভে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হয়েছে ইতিমধ্যে। তাঁদের আশঙ্কা, এই আইনের ফলে অসমকে বাঙালিমুক্ত করা যাবে না।
ফলে কেবল মুসলমান বাঙালিরা নন, সামগ্রিক ভাবে বাঙালি সমাজের পক্ষেই অসম রাজ্যটি যে নরকপ্রতিম হয়ে উঠেছে, তা অনুমেয়।
লেখক প্রাক্তন সাংবাদিক