দ্বৈরথ: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বাদানুবাদ চলছে জিম আকস্তা-র। ৭ নভেম্বর, ২০১৮। এএফপি
জিম আকস্তা নামটার সঙ্গে আমার-আপনার পরিচিত হওয়ার নিতান্তই কোনও কারণ ছিল না। সিএনএন-এর সাংবাদিক, হোয়াইট হাউজ়ে টিভি চ্যানেলটার প্রধান প্রতিনিধি। কিন্তু, তাঁকে না চিনেও আর উপায় থাকল না। খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রবল বিবাদে জড়িয়ে হোয়াইট হাউজ়ে প্রবেশের ছাড়পত্র খোয়ালেন আকস্তা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর বিবাদের প্রসঙ্গে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধু এটুকু মনে করলেই চলবে যে আকস্তাকে আক্রমণ করার সময় ট্রাম্প ক্রমাগত বলে গিয়েছিলেন, আকস্তা মিথ্যে কথা বলেন, সিএনএন মিথ্যে খবর প্রচার করে। ফেক নিউজ়। শুধু এই বিবাদের দিনটিতে নয়, মিডিয়াকে আক্রমণ করার জন্য ট্রাম্পের সব চেয়ে পছন্দের অস্ত্র মিথ্যে খবর প্রচারের অভিযোগ। সেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের, হিসেব বলছে, যিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম ৬০০ দিনে পাঁচ হাজারটিরও বেশি মিথ্যে কথা বলেছেন প্রকাশ্যে।
শুধু ট্রাম্পের কথা বললে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ভারী অন্যায় হবে। তাঁর বলা অর্ধসত্য আর মিথ্যের হিসেব কষার অবকাশ নেই, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতি তাঁর অশ্রদ্ধাও ভারী প্রকট। ‘প্রেস্টিটিউট’ কথাটা যে রাজনীতির মঞ্চে নিতান্তই তাঁর সমসাময়িক, তাঁর জমানাতেই যে দলের ছোট-বড় নেতারা যে কোনও সমালোচনাকে ফেক নিউজ় বলে দেগে দিতে অভ্যস্ত হয়েছেন, সে কথা ভুললে চলবে কী করে? গত এপ্রিলে কেন্দ্রীয় সরকার একটা আইন তৈরি করার চেষ্টা করেছিল— কোনও সংবাদমাধ্যমে ভুয়ো খবর প্রচারিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা হবে। দেশ জুড়ে তুমুল সমালোচনা আরম্ভ হওয়ায় তড়িঘড়ি সেই চেষ্টা বাতিল হয়। কিন্তু, তাতে মূল কথাটা হারিয়ে যায় না। আমেরিকায় যেমন ডোনাল্ড ট্রাম্প, এখানেও তেমন মোদী প্রশাসনের মত, ফেক নিউজ় বা ভুয়ো খবর প্রচার করে প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমই। কাজেই, তাদের কথায় বিশ্বাস করার দরকার নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রাও খুব অন্য কথা বলেন না।
ফেক নিউজ় নিয়ে সাম্প্রতিক কালে উথালপাথাল হইচই চলছে। কী ভাবে ঠেকানো যায় এই ভুয়ো খবরের রমরমা, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় হারিয়ে গিয়েছে তারও আগের প্রশ্নটা— ফেক নিউজ়ের এ হেন বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হল কেন? সেই প্রশ্নের স্বভাবতই একটা উত্তর নয়। কিন্তু, তাতে ট্রাম্প-মোদীদের আক্রমণের ভূমিকা বিপুল। খেয়াল করে দেখুন, হোয়াটসঅ্যাপ আর ফেসবুকে এমন কত মেসেজ পেয়েছেন, যাতে কোনও খবর জানিয়ে সঙ্গে লেখা রয়েছে, খবরের কাগজ আর নিউজ় চ্যানেলগুলো কখনও প্রচার করবে না এই সংবাদ, কাজেই মানুষের কাছে খবরটাকে পৌঁছে দিতে যথাসাধ্য ফরওয়ার্ড করুন? হয়তো করেছেনও ফরওয়ার্ড। যে হেতু প্রচলিত সংবাদমাধ্যম মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়, তাই সাধারণ মানুষও হয়ে উঠতে পারে খবরের কাগজ বা চ্যানেলের বিকল্প, তৈরি করতে পারে নতুন সংবাদমাধ্যম— ফেক নিউজ়ের রমরমার গোড়ায় রয়েছে এই বিশ্বাসটা।
এ দেশে যাঁরা বিশ্বাস করছেন যে মোবাইলে আসা মেসেজ ফরওয়ার্ড করে করেই তাঁরা অন্যদের কাছে সেই সব খবর পৌঁছে দিতে পারবেন, কাগজ যে খবরগুলো চেপে দেয়, তাঁরা মূলত ফরওয়ার্ড করে চলেছেন দক্ষিণপন্থী ফেক নিউজ়। শুধু প্রত্যক্ষ ভাবে রাজনৈতিক খবরই নয়, জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়ে তুলতে পারে, ফরওয়ার্ড হচ্ছে এমন বহু মেসেজ। অভিযোগ, যে ভুয়ো খবরের অধিকাংশেরই জন্ম বিজেপির আইটি সেলে। কিন্তু, যাঁরা সেই মেসেজগুলো ফরওয়ার্ড করে চলেছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই কি মনেপ্রাণে বিজেপি সমর্থক? অন্তত, গোড়া থেকেই ছিলেন? ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। খবরের কাগজ আর চ্যানেলগুলো তাঁদের ভুল বোঝাচ্ছে, অনেক খবর চেপে যাচ্ছে— এই ঠকে যাওয়ার হাত থেকে নিজেকে ও অন্যদের বাঁচাতেই তাঁরা ফরওয়ার্ড করছেন মেসেজগুলো। ফেক নিউজ়ের কথা তাঁরা জানেন বটে। কিন্তু, সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতের বেশির ভাগ মানুষের মনে গভীর বিশ্বাস রয়েছে যে ভুয়ো খবর দেখলে তাঁরা বুঝতে পারেন। বিশ্বাসটা ভিত্তিহীন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমের প্রতি অবিশ্বাস আর নিজেদের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস— দুই রণপায় ভর দিয়ে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ফেক নিউজ়কে। আর, মনোবিজ্ঞানীরা বলবেন, যে খবর কেউ নিজে অন্য কাউকে দিয়েছেন, তাতে নিজে বিশ্বাস করার সম্ভাবনা অনেক বাড়ে। আইটি সেলের ভুয়ো খবর ফরওয়ার্ড করতে করতেই এক সময় বিজেপির রাজনীতিতে বিশ্বাসী হয়ে পড়ার সম্ভাবনা কম নয়।
এক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে পড়লাম, পশ্চিমবঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কী ভাবে সমর্থক তৈরি করছে বিজেপি। সে খবর সত্যি কি না, হলফ করে বলা মুশকিল, কিন্তু প্রতি দিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার এতই মিল যে সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ফেসবুকে কে কোন ছবি শেয়ার করছে, কে কোন পেজ লাইক করছে, আর কী মন্তব্য করছে, একেবারে পাড়া স্তরে নাকি তার খোঁজ রাখছেন কর্মীরা। আইটি সেলও খোঁজ জানাচ্ছে। যাঁর লাইক, কমেন্ট আর শেয়ার দেখে মনে হচ্ছে যে তাঁকে টেনে আনা যাবে দলের দিকে, কর্মীরা তাঁকে জুড়ে নিচ্ছেন হোয়াটসঅ্যাপে। দলের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। আরও বেশি ‘খবর’ ফরওয়ার্ড করছেন তাঁকে। কিছু দিন আগেও যাঁরা ছিলেন প্রায় অরাজনৈতিক, সামান্য হিন্দুত্ব-ঘেঁষা, নিয়মিত ‘খবর’ পেতে পেতে, এবং সেই খবর ফরওয়ার্ড করতে করতে তাঁরা হয়ে উঠছেন নিশ্চিত ভোটার। আরও এক ধাপ এগিয়ে, অনেকে তৈরি করে ফেলছেন পরের দফার ভোটারদেরও। ফেক নিউজ় তো শুধু ভুল খবর ছড়ানোর জন্য নয়, সেটা আসলে রাজনীতির হাতিয়ার।
আরও স্পষ্ট করে বললে, হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির হাতিয়ার। ফেক নিউজ় কেন মূলত বিজেপিরই অস্ত্র হল, সেই প্রশ্নের অনেক রকম উত্তর হয়। খোঁচা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে বলতে পারতাম, বিজেপি বা তার পূর্বসূরিদের সম্বন্ধে মন্দ কথা বলার জন্য তো মিথ্যে খবরের প্রয়োজন হয় না— তার জন্য সত্যিই যথেষ্ট। কিন্তু, খোঁচাটা মুলতবি থাকুক। একটা চটজলদি উত্তর হল, আইটি সেল তৈরি করার কথা বিজেপি যত আগে ভেবেছে, যত অর্থ ব্যয় করেছে, সেটা অন্যরা করেনি। কিন্তু, তাতেও সব কথা বলা হয় না। কংগ্রেস যদি ২০১২ সালে তৈরি করে ফেলতে পারত ফেক নিউজ় তৈরির কারখানা, তারাও কি এতটাই সফল হত? সম্ভবত না। কারণ, ফেক নিউজ় বস্তুটার মূল চালিকাশক্তি হল মানুষের মনের গহনে থাকা নিরাপত্তাহীনতার আদিম বোধ। যে খবর সেই বোধকে উস্কে দিতে পারে, তার সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। উদারপন্থী রাজনীতির সব চেয়ে বড় দুর্বলতা হল, তা নির্ভর করে মানুষের যুক্তিবোধের ওপর। উগ্র জাতীয়তাবাদীই হোক বা হিন্দুত্ববাদী, কোনও বিদ্বেষের রাজনীতিরই যুক্তির ধার ধারার দায় থাকে না। তাদের কাজ মানুষের আবেগকে— নিরাপত্তাহীনতার বোধকে— ব্যবহার করা। এক সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতের সিংহভাগ ফেক নিউজ়ই নরেন্দ্র মোদীর সমর্থনে তৈরি। কেন, বুঝতে অসুবিধে আছে কি আর?
ফেক নিউজ়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার আগে এই কথাগুলো মনে রাখা তাই খুব দরকার। মূল সমস্যা প্রযুক্তির নয়। বস্তুত, প্রযুক্তি ফেক নিউজ়কে আরও পুষ্টই করবে। আরও নিখুঁত জাল ভিডিয়ো তৈরি করা সম্ভব হবে। বিগ ডেটা আরও মোক্ষম বেছে নিতে পারবে সম্ভাব্য সমর্থকদের। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোকে চাপে রাখা অবশ্যই প্রয়োজন— ফেক নিউজ় ঠেকাতে তাদের যা যা করার, করিয়ে নিতেই হবে— কিন্তু, তাতে সমাধান হবে না। কারণ, ফেক নিউজ়ের রমরমার গল্পটা রাজনৈতিক। তার সমাধানও রাজনৈতিকই হতে হবে। সেই রাজনীতি কোন পথে চলবে, নেতারা ঠিক করবেন। নাগরিক সমাজও ঠিক করবে। কিন্তু, গণমাধ্যমগুলোর ওপর যে ভরসা গত কয়েক বছরে নষ্ট করে দিতে পেরেছেন নরেন্দ্র মোদীরা, তাকে ফিরিয়ে আনা ছাড়া সম্ভবত ফেক নিউজ়ের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি তৈরি করা অসম্ভব।