দেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবীদের উনপঞ্চাশ জন সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তাঁরা দেশের বিবিধ অপরাধের বাৎসরিক সরকারি নথি (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো রিপোর্ট) ও অন্যান্য সূত্র উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে আছেন দেশের দলিত, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য পশ্চাদপদ মানুষজন। গণপ্রহার বা সামাজিক হিংসার ঘটনায় এঁরাই আক্রান্ত বেশি। জনসংখ্যার অনুপাতেও তাঁদের উপর আক্রমণের আধিক্য অনেক বেশি।
চিঠিটি তুলে আনে এক জরুরি প্রশ্ন। এ দেশে জেলবন্দিদের মধ্যে দলিত, আদিবাসী বা মুসলমানের অনুপাত কত? জনসংখ্যার অনুপাতে সেই সংখ্যা সামঞ্জস্যপূর্ণ? মোদী বা মমতা সরকারের জমানায় এঁদের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে? এত দিন সে প্রশ্নের উত্তর মিলত ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো বা এনসিআরবি-র ‘ভারতীয় জেল পরিসংখ্যান’ রিপোর্টে। জেলবন্দিদের মধ্যে দলিত, আদিবাসী ও হিন্দু মুসলমান বন্দির সংখ্যা উল্লেখ থাকত জেলবন্দিদের পরিসংখ্যানে। ১৯৯৫-২০১৫— এই রিপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশিতও হয়েছে।
কিন্তু ২০১৬ সালের রিপোর্ট প্রকাশিত হল ২০১৯ সালে। বিলম্বের সঙ্গে এল তথ্যের ধারাবাহিকতায় ছেদ। এত দিনের প্রথা ভেঙে এ বারের রিপোর্টে দলিত-মুসলিম জেলবন্দিদের সংখ্যা, শতাংশের হিসেবে তাঁদের অবস্থান, কিছুই বলা হল না। কেন এই পরিবর্তন? কেন এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করা হল? তার উত্তর কেন্দ্রীয় সরকার বা এনসিআরবি দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি।
২০১৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা দেশে জেলবন্দির মধ্যে দলিতের সংখ্যা মোট বন্দির প্রায় একুশ শতাংশ। বিচারাধীন বন্দির মধ্যেও অনুপাত প্রায় একই। অথচ ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী দেশে দলিত মানুষের অনুপাত ছিল ষোলো শতাংশ। একই ভাবে, আদিবাসী বন্দি মোট বন্দির চোদ্দো শতাংশ (বিচারাধীন বন্দিদের মধ্যে বারো শতাংশ), যদিও দেশে আদিবাসী মানুষের অনুপাত আট শতাংশ। মুসলিমদের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, জেলবন্দির প্রায় ষোলো শতাংশ বন্দি (বিচারাধীন বন্দির একুশ শতাংশ) মুসলিম, যদিও তাঁরা দেশবাসীর চোেদ্দা শতাংশ। অর্থাৎ দলিত, আদিবাসী এবং মুসলিম জেলবন্দির অনুপাত জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাতের চাইতে অনেকটাই বেশি। সমাজবিজ্ঞানী, গবেষক, সমাজকর্মী এবং নীতিনির্ধারকদের কাছে অতীব মূল্যবান এই তথ্যপঞ্জি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের নিয়ন্ত্রণাধীন এনসিআরবি প্রকাশ করা বন্ধ করে দিল হঠাৎ, কোনও ব্যাখ্যা ছাড়াই।
যদি বরাবরের মতো এই পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সমাজের অপরাধচিত্র নিয়ে সব চর্চা, গবেষণাই বন্ধ হয়ে যাবে। নেওয়া যাবে না কোনও সংশোধনী ব্যবস্থাও। আক্ষেপ, ভোট রাজনীতিতে নিমজ্জিত রাজনৈতিক দলগুলিও জেলবন্দিদের মধ্যে কিছু জনগোষ্ঠীর আধিক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। যদিও দলিত, আদিবাসী বা মুসলমানরা তাঁদের ‘ভোটব্যাঙ্ক’।
বন্দিদের মধ্যে দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের সংখ্যা তাঁদের জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি কেন? কেউ বলছেন এটা কাঠামোগত হিংসা ও নিপীড়নের প্রমাণ। কারও মতে এঁদের শিক্ষার অভাব ও দারিদ্রের কারণে অপরাধপ্রবণতা বেশি। কারও মতে আবার দলিত, আদিবাসী, মুসলমান আইনজীবী যথেষ্ট সংখ্যায় না থাকার কারণে এঁরা বেশি মাত্রায় জেলবন্দি। পুলিশ-প্রশাসনে এঁদের সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। ২০১৭ সালের একটি গবেষণাপত্রে দেখা যাচ্ছে, সংরক্ষণের জন্য পুলিশকর্মীদের মধ্যে দলিত ও আদিবাসীর সংখ্যা কিছু বাড়লেও, কমেছে মুসলিমদের অনুপাত (২০০১ সালে ৮.৪ শতাংশ থেকে ২০১৩ সালে ৬.২ শতাংশ)।
আর একটি সূত্র পাওয়া যায় আরও সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে। দু’টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা প্রায় বারো হাজার পুলিশকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছিল মুসলিম, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি তাঁদের মনোভাব বোঝার জন্য। অর্ধেক পুলিশকর্মী বলেছেন, মুসলিমরা নাকি ‘স্বভাবগত ভাবে’ অপরাধপ্রবণ। তিন জনের এক জন পুলিশকর্মী একই কথা মনে করেন দলিত ও আদিবাসীদের সম্পর্কে। সেই সঙ্গে, অর্ধেকেরও বেশি পুলিশকর্মী মনে করেন যে দলিত-আদিবাসীদের উপর অপরাধের যে সব অভিযোগ লেখানো হয়, সেগুলো ভুয়ো এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত (‘স্টেটাস অব পোলিসিং ইন ইন্ডিয়া রিপোর্ট, ২০১৯’)।
এমন ‘ধারণা’ যে কত নির্ণায়ক হতে পারে, তার একটা ইঙ্গিত মেলে অন্য ভাবে। এই সমীক্ষায় পাঁচ জন পুলিশকর্মীর চার জন বলেছেন, স্বীকারোক্তি আদায় করতে বন্দিকে প্রহার করা যেতে পারে। চার জনে তিন জন অপরাধীর উপর পুলিশের হিংসাকে সমর্থন করেছেন। গোহত্যা, শিশুধর্ষণে অভিযুক্তকে গণপ্রহার করা ভুল নয়, এমনও মনে করেন বেশ কিছু পুলিশকর্মী।
হিংসার প্রতি এই সহনশীলতা কি পুলিশ লক-আপে এবং জেলে বন্দিমৃত্যু, বন্দি-নিপীড়নের অন্যতম কারণ নয়? একই ভাবে, প্রান্তবাসীদের অধিক কারাবাসের কিছু কারণ পুলিশব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থার মধ্যেই রয়েছে কি না, দেখতে হবে বইকি। জেল পরিসংখ্যানের পরবর্তী রিপোর্টগুলিও যদি দলিত, আদিবাসী, মুসলিম বন্দিদের তথ্য গোপন করে, তাতে সেই বন্দিদের কোনও উপকার হবে না, সমাজেরও না। অন্ধকার সে সব ছবি এখনই আলোয় আনা দরকার।