জগদ্ধাত্রী পুজো।
“বারোইয়ারি প্রতিমাখানি প্রায় বিশ হাত উঁচু। ঘোড়ায় চড়া হাইল্যান্ডের গোরা বিবি পরী নানাবিধ চিড়িয়া, শোলার ফল ও পদ্ম দিয়ে সাজানো। মধ্যে মা ভগবতী, জগদ্ধাত্রী মূর্তি। সিঙ্গির গায়ে রুপুলি গিলটি ও হাতি সবুজ মখমল দিয়ে মোড়া।... বেলা আটটার সময় যাত্রা ভাঙল একজন বাবু মাতাল পাত্র টেনে বিলক্ষণ পেকে যাত্রা শুনছিলেন। যাত্রা ভেঙে যাওয়াতে গলায় কাপড় দিয়ে প্রতিমে প্রণাম কত্তে গেলেন। (প্রতিমে হিন্দুশাস্ত্রসম্মত জগদ্ধাত্রী মূর্তি)। কিন্তু প্রতিমার সিঙ্গি হাতিকে কামড়াচ্ছে দেখে বাবু মহাত্মার বড়ই রাগ হল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাবু করুণার সুরে— ‘তারিণী গো মা কেন হাতির উপর এত আড়ি। মানুষ হলে টেরটা পেতে তোমায় যেতে হতো হরিণবাড়ি...’ গেয়ে প্রণাম করে চলে গেলেন।”
‘হুতোমের নকশা’য় জগদ্ধাত্রীর এমনই রূপ ধরা পড়েছে।
কিন্তু বঙ্গদেশে কী ভাবে এলেন এই দেবী, তা নিয়ে বিস্তর মতপার্থক্য আছে। এখন জগদ্ধাত্রী পুজো বললেই চন্দননগরের কথা আগে চলে আসে বটে। কিন্তু আদতে জগদ্ধাত্রীর সঙ্গে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অনিবার্য ভাবে জড়িয়ে আছেন। কেননা, বাংলাদেশ জগদ্ধাত্রী পুজোর ব্যাপক প্রচলনের মূলে স্বয়ং তিনি— এ বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত। গবেষক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী উপাসনায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছিলেন। তিনি এই পূজা বাংলায় চালাইয়া যান।” (১৩৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর রচনাবলির দ্বিতীয় খণ্ড)
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলন প্রসঙ্গে একাধিক জনশ্রুতি লোকের মুখে মুখে ফেরে। রাজস্ব বকেয়া পড়ায় নদিয়ারাজকে তৎকালীন বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁ মুর্শিদাবাদে তলব করেন এবং বন্দি করেন। শেষপর্যন্ত টাকা মিটিয়ে আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে কৃষ্ণচন্দ্র নৌকা করে নদিয়ায় ফিরছিলেন। নৌকায় বসে ঢাকের বাজনা শুনে জানতে পারলেন সে দিন বিজয়া দশমী। সে বছর দুর্গাপুজো করতে না পারার দুঃখে মহারাজ কাতর হয়ে পড়লে দেবী তাঁকে স্বপ্নাদেশ দেন। দুর্গাপুজোর একমাস পর কার্তিকের শুক্লা নবমী তিথিতে তাঁর স্বপ্নাদিষ্টের রূপের প্রতিমা নির্মাণ করিয়ে পুজোর আদেশ দেন কৃষ্ণচন্দ্রকে। সেই থেকেই নদিয়ায় জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা। যা পরবর্তী কালে গোটা বাংলা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
এই কাহিনির নানা রকমফের আছে। কেউ বলেন, তখন বাংলার সিংহাসনে ছিলেন নবাব মিরকাশিম। বেশ কয়েক লক্ষ টাকা রাজস্ব আদায় করতে কৃষ্ণচন্দ্র এবং তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে মুঙ্গের কারাগারে বন্দি করেন মিরকাশিম। মুক্তিলাভের আশায় কৃষ্ণচন্দ্র কারাগারে উপবাসে থেকে ধ্যান শুরু করেন। তত দিনে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছে। মনকষ্টে থাকা রাজাকে দেবী প্রসন্ন হয়ে স্বপ্নে দেখা দেন এবং পুরাণবর্ণিত জগদ্ধাত্রী পূজো করতে বলেন। তা হলেই রাজার দুর্গাপুজো দুঃখ দূর হবে। মহারাজ এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্ত হন কিন্তু। কৃষ্ণনগরে ফিরে নির্দিষ্ট দিনে কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পুজো করেন। আবার, কেউ বলেন, কৃষ্ণচন্দ্রকে খাজনার বাকি পড়ায় বন্দি করে ছিল মিরজাফর। সেটা ১৭৫৭ সাল।
অন্য দিকে, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী তাঁর ‘নবদ্বীপ মহিমা’তে অন্যকথা বলছেন। তাঁর মতে, “মহারাজ গিরিশচন্দ্রের পূর্ব্বে অস্মদেশে জগদ্ধাত্রী পূজা প্রচলিত ছিল না। উক্ত মহারাজের যত্নে তন্ত্র হইতে ঐ মূর্তি প্রকাশিত হয়। শান্তিপুরের নিকটবত্তী ব্রহ্মশাসন গ্রাম নিবাসী চন্দ্রচূড় ন্যায়পঞ্চানন নামক জনৈক তন্ত্রশাস্ত্র বিশারদ পণ্ডিত কর্তৃক ঐ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। পরে নবদ্বীপের পণ্ডিতগণের অনুমোদিত হইলে ঐ মূর্তির পূজা আরম্ভ হয়।”
যদিও এই সব পরস্পরবিরোধী জনশ্রুতির মধ্যে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনার ঠিক ইতিহাস খুঁজে পাওয়া ভার। মনে রাখতে হবে, ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’-এ জগদ্ধাত্রী পুজোর কোনও উল্লেখ নেই। আলিবর্দির কারাগার থেকে বেরিয়েই কৃষ্ণচন্দ্র জগদ্ধাত্রী পুজো করলে তা ভারতচন্দ্র নিশ্চয়ই ‘অন্নদামঙ্গল’-এ (রচনাকাল ১৭৫২) তার উল্লেখ করতেন। নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেবের মতে, “যতটুকু জানা যায় ১৭৫২-৫৬, এই সময়কালের মধ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র বারোদোল, রাস বা জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। কেননা, ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাঁর আর্থিক সঙ্কট প্রবল হয়েছিল। ফলে, সে সময়ে এত বড়মাপের পুজোর আয়োজন করা সম্ভব ছিল না।” একই কথা বলা যায় মিরকাশিম প্রসঙ্গেও। অলোককুমার চক্রবর্তী তাঁর ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এবং তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এ লিখেছেন, “যাঁরা বলেন যে মিরজাফরের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে কৃষ্ণচন্দ্র এই পূজা করেন, তাঁদের কথাও ঠিক নয়। কেননা, মিরজাফরের কারাগারে কৃষ্ণচন্দ্র কোনওদিন বন্দি ছিলেন না।” তাঁর মতেও, “আলিবর্দির রাজত্বের ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তিনি হয়তো এই পূজা করে থাকবেন। আলিবর্দির কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেই তিনি এই পূজা প্রচলন করেছিলেন এমন কথাও মেনে নেওয়া যায় না। কেননা, ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই তিনি আলিবর্দির কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। মুক্তিলাভ করেই যদি তিনি এই পূজা করতেন তা হলে ভারতচন্দ্র নিশ্চয়ই এর উল্লেখ করতেন।”
অন্য দিকে, কান্তিচন্দ্র রাঢ়ী কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি গিরীশচন্দ্রকে (১৮০২- ১৮৪১) এই পুজোর প্রবর্তক বলে যে দাবি করেছেন তা-ও ঠিক নয় বলেই মনে করেন পণ্ডিতেরা। তিনি যদি জগদ্ধাত্রী পূজোর প্রবর্তক হবেন, তা হলে নদিয়ার জলেশ্বর শিবমন্দির (১৬৬৫) এবং দিগনগরের রাঘবেশ্বর মন্দিরের (১৬৬৯) গায়ে জগদ্ধাত্রী মূর্তি খোদাই করা থাকত না। সব মিলিয়ে ইতিহাস গবেষকেরা নিশ্চিত— মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বঙ্গদেশে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। এ কথা বলেছেন রাজ পরিবারের ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য লেখক দেওয়ান কার্তিকেয় চন্দ্র। তবে এ কথাও ঠিক যে কৃষ্ণচন্দ্র-পরবর্তী সময়ে গিরীশচন্দ্রের আমলে জগদ্ধাত্রী পুজোয় ব্যাপক জাঁকজমক হত। সে সময়ে ইংরেজরাও পুজো দেখতে আসত। অন্য দিকে, কৃষ্ণচন্দ্রের বন্ধু চন্দননগরের ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এই পুজো শুরু করেন। তবে, পুজো প্রকরণ কৃষ্ণনগরের চেয়ে ভিন্নতর চন্দননগরে।
এ হেন জগদ্ধাত্রী শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘জগৎ’ যোগ ‘ধাত্রী’। জগৎ বা ত্রিভুবনের ধাত্রী (ধারণকর্ত্রী, পালিকা)। ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে বর্ণনা করা হয়েছে— “সিংহস্কন্ধ সমারূঢ়াং নানালঙ্কার ভূষিতাম্। চতুর্ভূজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্। শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্ত বামপাণিদ্বয়ান্বিতাম্। চক্রঞ্চ পঞ্চবাণাংশ্চদধতীং দক্ষিণে করে। রক্তবস্ত্রাপরিধানাং বালার্কসদৃশীতনুম্”— এই ভাবে। জগদ্ধাত্রী দেবীর মূর্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী নির্মলানন্দ বলেছেন, “অর্ক বা সূর্যই বিশ্বের পোষণকর্তা। পৃথিব্যাদি আবর্তনশীল গ্রহ-উপগ্রহদিগকে সূর্যই নিজের দিকে আকর্ষণ করে রেখেছেন। দেবী জগদ্ধাত্রীর মধ্যেও ধারণী ও পোষণী শক্তির পরিচয় বিদ্যমান। তাই তাঁকে বলা হয়েছে বালার্কসদৃশীতনু। একই কারণে জগৎপালক বিষ্ণুর শঙ্খ চক্র শার্ঙ্গধনু আদি আয়ুধ দেবীর শ্রীকরে।... দেবীর রক্তবস্ত্র ও রক্তবর্ণের মধ্যে, দেবীর সিংহাসনস্থ রক্তকমলে সেই রজোগুণেরই ছড়াছড়ি। রজোদীপ্ত বলেই জগদ্ধাত্রী মহাশক্তিময়ী। তাঁর অস্ত্রশস্ত্র, তাঁর বাহন— সকলই তাঁর শক্তিমত্তার ভাবটি আমাদের অন্তরে উদ্দীপ্ত করে দেয়।”
জগদ্ধাত্রীর বাহন সিংহের পদতলে একটি হস্তীমুণ্ড থাকে। প্রচলিত বিশ্বাস, জগদ্ধাত্রী করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ মহাহস্তীরূপী অসুরকে বধ করেছিলেন। এই কারণে জগদ্ধাত্রী ‘করীন্দ্রাসুরনিসূদিনী’ নামে পরিচিত। রামকৃষ্ণ পরমহংসের ভাষায়— “মন করীকে যে বশ করতে পারে তারই হৃদয়ে জগদ্ধাত্রী উদয় হন।... সিংহবাহিনীর সিংহ তাই হাতিকে জব্দ করে রেখেছে।”
মনে করা হয়, সে সময়ে শাক্তধর্ম নানা অবিলতায় আছন্ন হয়ে পড়েছিল। তাঁকে স্বচ্ছ করার জন্য আগমবাগীশ যেমন দক্ষিণাকালীর পুজো প্রচলন করেন, নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রও তেমনই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। ধর্মাচারণের নামে স্বেচ্ছাচার রুখতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই ইতিহাসের আলোকে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
(উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত)