লেখাপড়া করে যে। মাদ্রাসা পরীক্ষা, মুর্শিদাবাদ, ২০১৪। ছবি: গৌতম প্রামাণিক
প শ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা কেমন আছেন? কয়েক মাস আগে লিভিং রিয়ালিটি অব মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ করে স্ন্যাপ-গাইডেন্স গিল্ড, প্রতীচী ট্রাস্টের সঙ্গে যৌথ ভাবে। রিপোর্টটি নিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় আলোচনা হয়। রিপোর্টটির মূল বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায় খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছেন। শুধু অর্থনৈতিক বিচারে নয়, সামাজিক ভাবেও।
২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারত সরকারের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সংক্রান্ত দফতর বেশ কিছু পদক্ষেপ করে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, যার মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায় সর্ববৃহৎ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সারা দেশে এমন নব্বইটি জেলাকে চিহ্নিত করা হয়, যার প্রত্যেকটিতে জনসংখ্যার অন্তত কুড়ি শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু। এই ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলি উন্নয়নের নিরিখে কতটা পিছিয়ে আছে, তা বিচার করার জন্য সাক্ষরতার হার, মহিলাদের সাক্ষরতার হার, কর্মে যোগদানের হার এবং কতগুলি পরিবারের পাকা বাড়ি, পরিস্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, শৌচালয় ইত্যাদি আছে— এই ধরনের
আটটি প্রধান নির্দেশক ব্যবহৃত হয়। এই সব নির্দেশক অনুসারে যে জেলাগুলি জাতীয়
গড়ের থেকে পিছিয়ে রয়েছে, সেই নব্বইটি জেলাতেই ২০০৭-০৮ সালে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ সমীক্ষা করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গে এগারোটি জেলা এই সমীক্ষার আওতায় পড়ে। আইসিএসএসআর-এর তত্ত্বাবধানে কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-কে এই সমীক্ষাটির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই এগারোটি জেলা হল কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম, হাওড়া, নদিয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা। এই সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রচিত রিপোর্ট কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু দফতরে জমা পড়ে। প্রত্যেকটি জেলার জেলাশাসকের দফতরেও জমা পড়ে রিপোর্টগুলি, যাতে এর ভিত্তিতে উন্নয়নমূলক পরিকল্পনাগুলি সহজে তৈরি করা যায়।
দশটি প্রধান আর্থ-সামাজিক ঘাটতির উপর নির্ভর করে প্রতিটি জেলার জন্য আর্থিক অনুদানের কথা ঘোষিত হয়। পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রতিটি জেলার জন্য অতিরিক্ত পাঁচ কোটি টাকার আর্থিক সংস্থানও করা হয়। সমীক্ষাটি শুধুমাত্র ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর ভিত্তি করা নয়, সংখ্যালঘুরা যাদের তুলনায় ভাল বা খারাপ আছে, সেই হিন্দুদেরও এই সমীক্ষার অন্তর্গত করা হয়, যাতে ধর্মভিত্তিক উন্নয়ন-ঘাটতির ঠিক পরিমাপ সম্ভব হয় এবং ব্লকে তথা জেলায় সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব হয়। আইসিএসএসআর-এর ওয়েবসাইটে জেলা-ভিত্তিক রিপোর্টগুলি এখনও বিদ্যমান এবং এই তথ্যের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি গবেষণার কাজ প্রকাশিত হয়েছে অল্প কিছু দিন আগেই। লক্ষণীয়, স্ন্যাপ-প্রতীচীর যৌথ রিপোর্টে এই সমীক্ষার কোনও উল্লেখ নেই।
২০১৩ সালে স্ন্যাপ কর্তৃক করা সমীক্ষার সঙ্গে ২০১১ জনগণনার তুলনামূলক আলোচনা থেকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গের আঠারোটি জেলায় কতটা খারাপ আছেন। যেহেতু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার বিচারে পূর্বতন সমীক্ষায় মাত্র এগারোটি জেলা অন্তর্গত ছিল, তাই সেটি এবং স্ন্যাপ-প্রতীচীর যৌথ রিপোর্ট থেকে সেই এগারোটি জেলা নিয়ে কয়েকটি তুলনা করা যেতেই পারে। প্রশ্নটি খুবই সাধারণ: ২০০৮ থেকে ২০১৩-র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটেছে, না অবনতি?
প্রথমেই ধরা যাক সাক্ষরতার কথা। আগের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, মুসলমানদের সাক্ষরতার হার অন্যান্য সম্প্রদায়ের থেকে কম। এর মধ্যে উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদহ লক্ষণীয় রকম আলাদা। দক্ষিণ দিনাজপুরের মুসলমানদের নিরক্ষরতার হার অন্য ধর্মের মানুষের থেকে কম। স্ন্যাপ-এর সমীক্ষা বলছে, এ ক্ষেত্রে নিরক্ষরতার হার কমেছে সব জেলাতেই, শুধু মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা ছাড়া। আগের সমীক্ষায় মালদহ জেলার মুসলমান পুরুষদের মধ্যে নিরক্ষরতার হার ছিল ৫০.২৯ শতাংশ, যা স্ন্যাপের সমীক্ষা অনুযায়ী কমে দাঁড়িয়েছে ২৯.৮ শতাংশ। মহিলাদের মধ্যে এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৪৩.৯ শতাংশ, যা আগের সমীক্ষায় ছিল ৫৩.৫৫ শতাংশ। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরেও মুসলমান ছাত্রছাত্রীরা যে আগের তুলনায় অনেক বেশি যোগ দিচ্ছে, তাও এই সমীক্ষায় পরিষ্কার। পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, মুসলমান পরিবারে সন্তান প্রসবের জন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্রবণতা আগের তুলনায় বেড়েছে। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র দূরে হওয়ায় গ্রামের মানুষ সন্তান ধারণের জন্য ধাত্রী-নির্ভর ছিলেন। সেটা কমছে, যা উন্নয়নের লক্ষণ। মহিলা ডাক্তার না থাকার কারণে অনেক মহিলা হাসপাতালে যেতে চান না, সেটা অন্য প্রশ্ন।
সাধারণ ভাবে, পশ্চিমবঙ্গের জেলাস্তরে যে গ্রামীণ পরিবারগুলিতে সমীক্ষা চালানো হয়, সেগুলির মধ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের বাসস্থান ২০০৭-০৮ সালে ভাল অবস্থায় ছিল না। মালদহ জেলায় বৈদ্যুতিকরণ ও পরিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা অবশ্য তখনই কিছুটা উন্নত ছিল, যদিও মানব উন্নয়ন নির্দেশক (এইচডিআই) অনুযায়ী মালদহের অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের সব জেলার মধ্যে নিম্নতম। বৈদ্যুতিকরণে উত্তর দিনাজপুরও বেশ উন্নত ছিল তখনই। লক্ষণীয়, এই বিষয়গুলির ভিত্তিতে আগের রিপোর্টের সঙ্গে স্ন্যাপ-প্রতীচীর রিপোর্ট তুলনা করলেই দেখতে পাওয়া যাবে যে, কোচবিহারে বিদ্যুৎ সংযোগহীন মুসলমান বাসস্থানের অনুপাত ২০০৮ থেকে ২০১৩-র মধ্যে ৯৩ থেকে ৪৭ শতাংশে নেমেছে। মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলমান পরিবারের গৃহে বিদ্যুৎ সংযোগ ২৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ, বর্ধমানে ৩৮ থেকে ৪৭.৫। মালদহে ২০০৭-০৮ সালের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী ২.১৬ শতাংশ মুসলমান পরিবার থাকতেন পাকা বাড়িতে— নতুন রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯.৬ শতাংশ এখন পাকা বাড়িতে থাকেন। উত্তর চব্বিশ পরগনায় অনুপাত যথাক্রমে ১৬.৫৮ এবং ১৬.৫ শতাংশ, বীরভূমে ৮.২৩ এবং ১১.৪ শতাংশ। গত পাঁচ-সাত বছরে কিছু সদর্থক পরিবর্তন ঘটেছে বইকী।
আরও গভীর তুলনা করলে দেখা যাবে, নতুন সমীক্ষা অনুসারে, মুসলমান সম্প্রদায়ের পুরুষ কর্মীরা অন্তত কিছুটা হলেও বেশি সরকারি চাকরি পেয়েছেন। এগারোটি জেলার মধ্যে বীরভূমে এই অনুপাত সর্বাধিক (২.৯ শতাংশ)। পূর্বতন সমীক্ষা অনুযায়ী, সংখ্যালঘু নন এমন পুরুষ সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা সর্বাধিক ছিল হাওড়ায় (৫.১৭ শতাংশ)। এই তারতম্য অকিঞ্চিৎকর, বিশেষ করে যে দেশে অধিকাংশ কর্মীই আছেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক ক্ষেত্রেও মুসলমান সম্প্রদায় আগের সমীক্ষার তুলনায় এই সমীক্ষা অনুযায়ী পিছিয়ে নেই।
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু মানুষের আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা নিয়ে নতুন করে বিচলিত হয়ে পড়ার বিশেষ কারণ নেই। কোনও সন্দেহ নেই যে, যথার্থ উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়, সেখানে পৌঁছতে শুধু মুসলমান সম্প্রদায়কে কেন, গোটা দেশকেই এখনও অনেক দূর যেতে হবে। কিন্তু যেটুকু ভাল পরিবর্তন ঘটেছে, তাকে লঘু করে দেখানো কাম্য নয়।
অর্থনীতিবিদ, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর সঙ্গে যুক্ত