New Academic System

নতুন নীতি আরও ক্ষতিকর

এই ভাবেই শিক্ষকের অভাব উচ্চশিক্ষাকে অর্থহীন নিয়মরক্ষায় পরিণত করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষা বলছে, ২০১৩-১৪ সালে ভারতে উচ্চশিক্ষার্থী ছিল ৩ কোটি ২৩ লক্ষ, শিক্ষক ১৩ লক্ষ ৬৭ হাজার।

Advertisement

পারমিতা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০০:০১
Share:

পুরুলিয়ার খেতমজুর পরিবারের ছেলে অর্জুন মাহাত উচ্চ মাধ্যমিকের পর কোনও মতে ভর্তির টাকা জুটিয়ে ঢুকেছেন কলেজে। বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। অর্জুন জানালেন, সারা দিনে একটিই ক্লাস হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্সের। তা-ও রোজ নয়। কারণ, ওই কলেজে মাত্র এক জন অতিথি শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ান। অতিথি শিক্ষকেরা একই সঙ্গে অনেকগুলি কলেজে পড়াতে পারেন। ফলে সব কলেজে প্রতি দিন যান না। কী ভাবে চলে তা হলে পড়াশোনা? অর্জুন জানান, কী কী বিষয় থেকে প্রশ্ন আসবে তা নির্ধারিতই থাকে। সেটুকুই পড়িয়ে দেন স্যর। একই অবস্থা সুন্দরবনের স্বাতী সর্দারের। তাঁর সংস্কৃত অনার্সের (‘কোর’ কোর্স) ভরসা দু’জন অতিথি শিক্ষক। ওই কলেজেরই এক শিক্ষিকা জানালেন, বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়ালে বছরে তিনটি সিমেস্টারের পাঠ্যক্রম শেষ হয় না। তাই প্রশ্ন-উত্তর লিখিয়ে দেন তাঁরা।

Advertisement

এই ভাবেই শিক্ষকের অভাব উচ্চশিক্ষাকে অর্থহীন নিয়মরক্ষায় পরিণত করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সমীক্ষা বলছে, ২০১৩-১৪ সালে ভারতে উচ্চশিক্ষার্থী ছিল ৩ কোটি ২৩ লক্ষ, শিক্ষক ১৩ লক্ষ ৬৭ হাজার। ২০১৭-১৮ সালের হিসেব, ছাত্র বেড়েছে ৪৩ হাজার, শিক্ষক কমেছে ৮৩ হাজার।

পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা দফতরের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী ছাত্র বাড়ছে রাজ্যেও। বাড়ছে কলেজও। রাজ্য সরকারের দাবি, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একত্রিশটি নতুন সরকারি এবং পনেরোটি সরকার পোষিত কলেজ কাজ শুরু করেছে। পরবর্তী বছরগুলিতে গড়ে উঠেছে আরও কিছু কলেজ। কিন্তু কমছে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত। উচ্চশিক্ষা দফতরের এক আধিকারিক জানালেন, বছরখানেক আগেও এ রাজ্যে ওই অনুপাত ছিল ২৬:১। এখন সেটাই ৩৯:১। সরকারি কলেজে অনার্স (‘কোর কোর্স’) ক্লাসে পড়ুয়া থাকে পঁচিশ-ত্রিশ জন, সরকার পোষিত কলেজগুলিতে আরও বেশি। পাস বা জেনারেল (‘প্রোগ্রাম কোর্স’) ক্লাসে ছাত্রসংখ্যা সর্বাধিক।

Advertisement

বর্তমানে এ রাজ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় একত্রিশ হাজার। তার মধ্যে আংশিক সময়ের, অতিথি ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের সংখ্যা প্রায় চোদ্দো হাজার। মানে, প্রায় পঁয়তাল্লিশ শতাংশ শিক্ষক এত দিন একাধিক কলেজে ক্লাস করাতেন। অন্তত, করাতে পারতেন। জেলার অনেক কলেজেই পঠনপাঠন অতিথি শিক্ষক-নির্ভর।

এ বছর থেকে চিত্রটা বদলে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী গত অগস্টে ঘোষণা করেছিলেন, কলেজের আংশিক সময়ের, অতিথি ও চুক্তিভিত্তিক শিক্ষকদের এক ছাতার তলায় এনে নির্দিষ্ট বেতনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে। এঁদের পরিচয় হবে, ‘স্টেট এডেড কলেজ টিচার’ বা স্যাক্ট। ২৩ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে উচ্চশিক্ষা দফতর। পয়লা জানুয়ারি থেকেই প্রায় দশ হাজার শিক্ষক এর আওতায় এসেছেন। এঁরা এত দিন একাধিক কলেজে নির্দিষ্ট কয়েকটি ক্লাস নিতেন। ‘স্যাক্ট’-এর আওতায় এলে তাঁদের যে কোনও একটি কলেজ বেছে সপ্তাহে ১৫ ঘণ্টা পড়াতে হবে। যে কলেজটি ছাড়বেন, সেখানে একটি পদ ফাঁকা হয়ে যাবে। শিক্ষা দফতরের অনুমোদন না নিয়ে নতুন অতিথি শিক্ষক নিয়োগও করতে পারবে না কলেজ। ফলে প্রমাদ গনছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।

ক্ষুব্ধ ছাত্রছাত্রীরাও। অতিথি বা আংশিক সময়ের শিক্ষকদের অনেকেই নেট বা সেট উত্তীর্ণ নন, গবেষণাও করেননি। তাই প্রশ্ন উঠছে তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে। পড়ুয়ারা দাবি করছেন, পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক পাওয়ার অধিকার তাঁদের রয়েছে। এরই মধ্যে রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম (সিবিসিএস)। নতুন এই পঠন পদ্ধতি অনুসরণ করতে গেলে শিক্ষকের সংখ্যা আগের চাইতে বেশি হওয়া দরকার।

কলেজ সার্ভিস কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ চলছে। তার পরেও সব নতুন কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। একই দশা বহু পুরনো কলেজের। পশ্চিমবঙ্গে এমন কলেজও আছে, যেখানে গণিত বিভাগের দু’জন অতিথি শিক্ষকের এক জনও ‘স্যাক্ট’ চালু হওয়ার পর সেই কলেজটিকে বাছেননি। ফলে সেখানে গণিতের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে। হতাশ ছাত্রেরা বলেন, “কী আর করব! স্যরের কাছে প্রাইভেটে পড়তে হবে।” কলেজ শিক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন, নতুন নিয়মের ফলে তৈরি শূন্যতার ফল ভুগবেন ছাত্রছাত্রীরা।

সমস্যা আরও আছে। শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রশাসনিক কাজও শিক্ষকদের করতে হয় অনেক কলেজে (কারণ শিক্ষাকর্মী অপ্রতুল)। কন্যাশ্রী-সহ নানা ধরনের বৃত্তির কাজের চাপে অনেক সময়ই ক্লাস নিতে পারেন না বলে জানিয়েছেন শিক্ষকেরাই।

শিক্ষক নিয়োগ নীতি নিয়েও প্রশ্ন। দেখা যাচ্ছে, সিএসসি বা পিএসসি-তে নিযুক্ত বহু শিক্ষকের বাড়িই তাঁদের কলেজ থেকে ২৫০-৩০০ কিলোমিটার দূরে। অভিযোগ, তাঁরা বেশি ছুটি নিয়ে থাকেন। শিক্ষকেরাও স্বীকার করেন, সপ্তাহান্তে যাতায়াতে যে সময় নষ্ট হয়, তা দিয়ে তাঁরা অনেক গঠনমূলক কাজ করতে পারতেন। মূল্যহীন ডিগ্রি হাতে বেরোচ্ছেন অজস্র ‘উচ্চশিক্ষিত’ তরুণ-তরুণী।

এই প্রতারণা কি জরুরি ছিল?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement