ভারতবিদ্বেষী বিদেশি ছবির ব্যাপক প্রদর্শন শুরু হয় ব্রিটিশ শাসিত ভারতে, যেমন ইন্ডিয়া স্পিকস (১৯৩৩), বেঙ্গলি (১৯৩৫), গুঙ্গা দিন (১৯৩৯) এবং স্টর্ম ওভার বেঙ্গল (১৯৩৮)। সারা বিশ্বের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতির বর্বরতা ও হীনতা প্রদর্শনই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রথম সরব হন সুভাষচন্দ্র বসু। মূলত তাঁর প্রতিবাদে প্রাণিত হয়েই ১৯৩৫ সালের ২৭ জুলাই কলকাতায় তৎকালীন ‘এলবার্ট হল’-এ (বর্তমান কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস) মেয়র ফজলুল হকের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদসভার আয়োজন হয়। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জ্যোতির্ময়ী গঙ্গোপাধ্যায়, অমৃত কুমারী, সুরেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ এই সভায় বক্তা ছিলেন। সুভাষচন্দ্রের প্রতিবাদের সমর্থনে এই সভায় কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করা হয়, যেমন আমেরিকা ও ইউরোপে ভারতবিরোধী যে সব অন্যায় প্রচার চলছে, তার প্রতিবাদ করে বিভিন্ন দেশের সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং এই সব অন্যায় প্রচার নিষিদ্ধ করা। ভারতে জনমত গঠনের জন্যে একটি কমিটিও গঠিত হয়, যার সভ্য ছিলেন মেয়র ফজলুল হক, ডেপুটি মেয়র সনৎ কুমার রায়চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নেলী সেনগুপ্ত, শরৎচন্দ্র বসু, মালেক আঙ্কেলসারিয়া, আব্দুল মোমিন, সামসুদ্দিন হোসেন প্রমুখ। ভারত সচিব এবং হলিউডের প্রযোজকদের কাছে প্রস্তাবের একটি অনুলিপি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
চলচ্চিত্রের বিনোদনমূলক সংজ্ঞার বাইরেও আর একটি পরিচয় রয়েছে, সেটা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক (অপ)প্রচারমূলক। পরাধীনতার সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিদেশি চলচ্চিত্রের রাজনৈতিক, সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক প্রোপাগান্ডামূলক পরিচয়টি লক্ষণীয়। প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি পাশ্চাত্যের নিকৃষ্ট মনের পরিচয় খুব প্রাঞ্জল ভাবে দেখতে পাওয়া যায় ১৯৮৪ সালে ইন্ডিয়ানা জোন্স ছবি-সিরিজ়ের টেম্পল অব ডুম থেকে শুরু করে ২০০৭ সালের থ্রি হান্ড্রেড ছবিতেও। প্রাচ্যের ‘নৈরাজ্য’-এর বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের ‘সভ্যতার ধ্বজাধারী’ এ রকম সিনেমা বিনোদনে একশো ভাগ টেক্কা দিলেও ভয়-অতীন্দ্রিয়তা-রহস্যে মোড়া প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রচার এই সব চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু। আমরাও এই ধরনের চলচ্চিত্র দেখি, উপভোগও করি। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখি না ছবির বিষয়বস্তু ও তার অবমাননাকর ইঙ্গিতগুলোকে।
প্রাচ্য তথা ভারতীয় সংস্কৃতির উপর এই কালিমা লেপনের বিরুদ্ধে এগিয়ে এসেছিলেন নেতাজি। চলচ্চিত্রের সঙ্গে সুভাষচন্দ্রের সম্পর্ক বহু দিনের। ১৯৩০-এর দশকে ‘চিত্রা’ (পরবর্তী কালে ‘মিত্রা’) সিনেমা হলের দ্বারোদ্ঘাটন করেন তিনি। দেশবাসীকে অনুরোধ করেন, বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য না দিয়ে দেশীয় ছবি তৈরি করতে। দেশের বাইরে ইউরোপের মাটিতেও প্রতিবাদী হয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। ভারতীয় ঐতিহ্যকে ভূলুণ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ইউরোপে ১৯৩০-এর দশকে শুরু হয় প্রোপাগান্ডামূলক ছবির প্রদর্শন। ভারতে এর আগে এ রকম ছবির বিরুদ্ধে দেশনেতারা সরব হয়েছেন কি না জানা নেই। ১৯২৭ সালে আমেরিকান ইতিহাসবিদ ক্যাথরিন মেয়ো একটি বই লেখেন মাদার ইন্ডিয়া নামে। প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা এই বই ভারত সম্বন্ধে অত্যন্ত কুৎসিত মন্তব্যে ভরা ছিল। এর প্রতিবাদে লালা লাজপত রাই, গাঁধীজির মতো নেতারা কলম ধরেছিলেন বটে, তবে সেই সময়ের চলচ্চিত্রে দেখানো ভারতসংক্রান্ত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অপব্যাখ্যার প্রতিবাদ করতে দেখা যায় না তখনকার কোনও নেতাকে।
এই প্রসঙ্গে হলিউডের দু’টি চলচ্চিত্রের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। একটি হল ইন্ডিয়া স্পিকস (১৯৩৩) আর অন্যটির নাম বেঙ্গলি (১৯৩৫)। ইন্ডিয়া স্পিকস ছবির বিষয়বস্তু ছিল পরিচালক রিচার্ড হ্যালিবারটনের ভ্রমণ বৃত্তান্ত, যা ক্যাথরিন মেয়োর মতোই মনে করিয়ে দেয় ভারত সম্বন্ধীয় ‘অল্প বিদ্যা’কে। নেতাজি তখন রোমে, ইউরোপের মাটিতে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। সেখানেই এক ঘরোয়া প্রদর্শনীতে প্রথম ছবিটি দেখেন তিনি, এবং যারপরনাই ক্ষুব্ধ হন। ছবিটিকে তিনি ক্যাথরিন মেয়োর মাদার ইন্ডিয়া-র চিত্রভাষা বলে আখ্যা দেন। সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারেন, এই ধরনের ছবির নেতিবাচক প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে রুদ্ধ করবে। এই বিষয়ে জনমত গঠনের গুরুত্বও তিনি অনুধাবন করেন। তিনি মনে করতেন, ভারতীয় চিত্রপরিচালকদের উচিত উন্নত মানের ভারত-বিষয়ক চলচ্চিত্র নির্মাণ করা, যা দেশ ও বিদেশে জাতীয়তাবোধ গঠনে ভারতীয় তরুণদের উজ্জীবিত করবে। পাশাপাশি এতে বিদেশে উন্নত মানের দেশীয় ছবির সমাদরও হবে। এভরিবডি লাইকস মিউজিক (১৯৩৪) নামে অন্য এক ছবিতে দেখানো হয়, তাঁর চিরাচরিত পোশাকে গাঁধীজি এক ইউরোপীয় মহিলার সঙ্গে নাচছেন। ভারতীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের উপর এমন রুচিহীন আক্রমণকে সেই সময় যথেষ্ট নিন্দা করেন সুভাষচন্দ্র।
অসুস্থ শরীরে ভিয়েনাতে থাকাকালীন, নেতাজি ১৯৩৫ সালে বেঙ্গলি (আসল নাম দ্য লাইভস অব আ বেঙ্গল ল্যান্সার, ভারতে বেঙ্গলি নামে প্রদর্শিত)নামে আর একটি ছবি দেখেন। এই ছবিতেও ভারতকে দেখানো হয় ভোজবাজি এবং রহস্যাবৃত এক দেশ হিসেবে, প্রাচ্যবাদী ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির যা অন্যতম নিদর্শন। এ ছাড়াও ছবিতে ভারতবাসীদের ভীরু ও কাপুরুষ জাতি হিসেবেও দেখানো হয়, এবং ব্রিটিশরাই যে তাঁদের ত্রাণকর্তা, সে কথা গর্বের সঙ্গে বলা হয়। ভিয়েনার ভারতীয়রা ছবিটি দেখে ক্ষুব্ধ হন। ১৯৩৫ সালের ১৭ এপ্রিল সুভাষচন্দ্র ভিয়েনার আর্চবিশপকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন এবং সেখানে অনুরোধ করেন ছবিটির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে। তিনি জানতেন এই চিঠিতে বিশেষ কাজ হবে না, তবুও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন ভেবে চিঠি লেখা থেকে বিরত হননি তিনি।
ভারতবিরোধী প্রোপাগান্ডা ছবির বিরুদ্ধে নেতাজির প্রতিবাদ যেমন অভূতপূর্ব, তেমনই তা দূরদৃষ্টিরও পরিচায়ক। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে অন্য কোনও জাতীয়তাবাদী নেতা এ রকম ভাবে ভাবতে পারেননি। দেশের সবচেয়ে বন্দিত নেতা তথা জাতির জনক মহাত্মা গাঁধীকে নিয়ে অনেক ছবি হয়েছে। তাঁর জীবন ও আদর্শ যত বার চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, তেমন হয়তো আর কোনও নেতাকে নিয়ে হয়নি। মহাত্মা গাঁধী কিন্তু আদৌ চলচ্চিত্রের অনুরাগী বা সমর্থক ছিলেন না। মিশন টু মস্কো একমাত্র পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি যা তিনি দেখেছিলেন। ফলে বিদেশে দেখানো ভারতীয় সংস্কৃতির অপপ্রচারমূলক সিনেমা সম্বন্ধে তিনি যে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বলে রাখা ভাল, সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসও বিদেশে ভারতীয় সংস্কৃতির যথাযথ প্রচার নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চায়নি। ব্যয় নির্বাহের জন্যে তহবিলের অপ্রতুলতার কথা বলেছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও অন্যতম শীর্ষ নেতা ভুলাভাই দেশাই। প্রত্যুত্তরে সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন, ইউরোপ ও আমেরিকায় এমন অনেক দক্ষ, যোগ্য ও অভিজ্ঞ ভারতীয় আছেন, যাঁরা অর্থের প্রত্যাশা না করেই দেশের কাজ করে যেতে প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে তিনি বিঠলভাই পটেলের নাম উল্লেখ করে বলেন, কংগ্রেস প্রতিনিধিরা যদি বিদেশে প্রচার করতে পারতেন, তা হলে অনেক বেশি সফল হতেন।
বলা যায়, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের এক নতুন রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন নেতাজি। ভারতীয় জাতীয়তাবোধ গড়ে তুলতে চলচ্চিত্রের মতো গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছিলেন তিনি। শুধু চলচ্চিত্রপ্রেমী হওয়াই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে ছবির সারবত্তা বুঝে নেওয়াটাও যে বিশেষ জরুরি, সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদের আদর্শ ও কার্যকালে প্রতিবাদ আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়।