প্রতিবাদ জারি আছে। নর্মদা বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে। দিল্লি, ১৩ জুন। ছবি: পিটিআই।
ভারতে এখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সেখানে বামপন্থী রাজনীতি কী হতে পারে? কেমন হতে পারে?
এটাই আমি বলার চেষ্টা করছিলাম (‘বড় সাফল্যের পর...’, ২৪-৬) যে, পুঁজিবাদের সমালোচনাটা কী হতে পারে, কেমন হতে পারে, সেটা বামপন্থীদের ভাবতে হবে। নতুন পুঁজিবাদের বাস্তবটাকে মাথায় রেখেই ভাবতে হবে, যারা সবচেয়ে দরিদ্র, প্রত্যন্তবাসী, আমি তার কথাটা কী করে বলব? এখানেই বামপন্থা।
এখানে একটা কথা ভেবে দেখার আছে। আমরা তো বার বার বলছি যে, নির্বাচনে বামপন্থীরা খুব মার খেল। বামপন্থীদের একটা অংশ কিন্তু তাদের শক্তি নিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। সেটা হল মাওবাদীরা। তারা এখানে মার খেয়ে ওখানে সরে যায়, কিন্তু এত বছর ধরে নিজেদের জায়গাটা ধরে রেখেছে। তার কারণ, ওদের সমালোচনাটা খুব স্পষ্ট। কিন্তু আবার অন্য দিকে, সেই সমালোচনাটা খুব সীমিত। এই এত বড় গাঙ্গেয় উপত্যকায় যে অগণিত চাষি, কিংবা শহরের যে দরিদ্র মানুষ, তাদের জন্যে মাওবাদীদের কিছু বলার নেই। ওরা ওই জঙ্গলে, ট্রাইবালদের মধ্যে কাজ করে, ওর বাইরে কিছু নেই। কিন্তু মাওবাদীদের প্রতি ওই অঞ্চলের মানুষের যথেষ্ট আনুগত্য আছে, সেটা মানতেই হবে। এটাও ঠিক, পার্লামেন্টারি রাজনীতি যারা করে তারা ওই অঞ্চলের মানুষের জন্যে প্রায় কিছুই করেনি।
বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় ভাবে, পাহাড় নিয়ে, জমি নিয়ে, নদী নিয়েবহু প্রতিবাদ, আন্দোলন হচ্ছে। বামপন্থী দলগুলো তো সাধারণত সেগুলোয় অংশ নেয় না।
তার কারণও তো ওই নতুন ভাবে ভাবতে না পারা। কোন আন্দোলনে যাব, সেটা ঠিক করতে গিয়ে সেই পুরনো চিন্তার ছকে বাঁধা থাকলে তো হবে না। এই যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, নর্মদার বাঁধ আরও উঁচু করে দেওয়া হবে। এর ফলে গ্রোথ হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু এর কিছু ভুক্তভোগী আছে, তাদের কথা তো ভাবতে হবে।
নতুন জমানায় তার প্রয়োজন তো বাড়বে বলেই মনে হয়।
সেই জন্যেই তো বুঝতে হবে যে, এই পুঁজিবাদের চেহারাটা আমাদের বইয়ে পড়া ক্যাপিটালিজমের মতো নয়। শুধু চটকল শ্রমিকের কথা ভাবলেই হবে না, নর্মদা প্রকল্পের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের কথাও ভাবতে হবে।
কিন্তু ভাবনার এই ঘাটতিটা কেন? এর কারণ কী?
আমার মনে হয়, নতুন রাজনৈতিক প্র্যাকটিস, কার্যক্রম, এগুলো নতুন করে ভাবতে হলে যে আত্মবিশ্বাস দরকার হয়, তার অভাব ঘটেছে। পরিচিত গতানুগতিক পথেই হাঁটার অভ্যেস... ওই যে একটা কথা বার বার বলা হয় যে, বন্ধ ডাকা ছাড়া কি প্রতিবাদের আর রাস্তা নেই? এটা কেন হয়? কারণ, করতে করতে ওটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। জানা আছে, কী করে করতে হয়। প্রতিবাদের নতুন অজানা কোনও উপায় ভেবে বের করার আত্মবিশ্বাস নেই।
এ রাজ্যে, বামপন্থী দলগুলোর মধ্যেও, এখনও উচ্চবর্ণের আধিপত্য, যে ব্যাপারটায় আপনি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এর ফলেই কি বাস্তবের সঙ্গে সংযোগ আরও দুর্বল হয়েছে?
এখানে কিন্তু আবার একটা কথা খেয়াল করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে স্থানীয় রাজনীতিতে, জেলা স্তরের নীচে, তথাকথিত নিম্নবর্ণের নেতাদের গুরুত্ব কম নয়। যত তুমি ওপরে উঠবে, সেটা কমে আসবে। কলকাতায় এসে আর পাবেই না।
এখানে তো একটা শ্রেণির প্রশ্নও আছে? কৃষক সভায় মধ্য চাষির নিয়ন্ত্রণ যে ভাবে ক্রমশই বাড়ল, সেটাও তো গুরুত্বপূর্ণ?
দেখ, পশ্চিমবঙ্গে তথাকথিত ভূমিসংস্কারের পরে যা দাঁড়িয়েছে, তাতে সত্যিকারের বড় চাষি তো আর প্রায় নেই। সবই মাঝারি থেকে ছোট। তারাই সিপিএমের স্থানীয় স্তরে প্রভাবশালী ছিল। তার ফলে কী হয়েছে... যখন প্রথম নরেগা এল, তখন আমি গ্রামে গিয়ে দেখেছি, সিপিএমের লোকেরাই বলছে, এটা হলে তো আমরা নিজেদের জমিতে কাজ করার লোক পাব না। এই ছোট জমির মালিক, এরাই পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের মেরুদণ্ড। খেতমজুররাও তো এদেরই জমিতে কাজ করে। এবং এই মাঝারি-ছোট চাষিদের পক্ষেই ক্রমশ শুধু কৃষি থেকে জীবিকা চালানো কঠিন হয়ে উঠল, চাষের খরচও বাড়ল, তখন আস্তে আস্তে অন্য নানা জীবিকার সন্ধান করল তারা। তার ফলেই তো এ-রকম লোকের সংখ্যা খুব বাড়তে লাগল, যারা গ্রামে থাকে কিন্তু কৃষি আর যাদের মূল জীবিকা নয়।
এই যে ছোট ছোট জমি, অল্প সামর্থ্য, এর তো একটা প্রতিকার হতে পারত যদি সমবায়ের প্রসার ঘটত?
এই ব্যাপারটা আমি অনেক ভেবেছি। তাতে আমার একটা কথা মনে হয়েছে। দেখ, পশ্চিমবঙ্গে সমবায় করার চেষ্টা কম হয়নি, অনেক জায়গায় হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই দাঁড়ায়নি। যে দু’চারটে হয়েছে, সেগুলো খুব স্থানীয় স্তরে, যেমন বীরভূমে পান্নালাল দাশগুপ্ত যা করেছিলেন। সেই মডেল আরও অনেক জায়গায় বড় করে করা যায়নি। মনে হয়, এর একটা ঐতিহাসিক কারণ আছে। সেটা হল, জমিদারি অঞ্চল এবং রায়তওয়ারি অঞ্চলের একটা তফাত আছে। ভারতে যে সব অঞ্চলে রায়তওয়ারি ভূমিব্যবস্থা ছিল, সেখানে গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের সমবায় তুলনায় ভাল কাজ করেছে। যেমন কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, গুজরাত ইত্যাদি। কিন্তু জমিদারি ব্যবস্থার এলাকাগুলিতে সমবায় সে ভাবে সফল হয়নি।
রায়তওয়ারি অঞ্চলের সমবায় মানে কিন্তু গরিবের সমবায় নয়, সম্পন্ন চাষির, জমির মালিকের সমবায়। উত্পাদন, মার্কেটিং ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমবায় সে-সব জায়গায় কাজ করে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ বিহার ওড়িশার মতো জায়গাগুলোতে ঐতিহাসিক ভাবেই এটা হয়নি। এখানে সমবায় মানে ছিল জমিদার উদ্যোগী হয়ে কিছু একটা তৈরি করতে চাইছেন। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগও কিন্তু এই মডেলেই। বেশির ভাগ জমিদার সমবায় করতেও দিত না, কারণ সেটা তার স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। কিন্তু যেটুকু যেখানে হয়েছে, বেশির ভাগই জমিদারের উদ্যোগে।
তার পর জমিদার চলে গেল, তখনও দেখা গেল কৃষকের উদ্যোগে সমবায় হয় না। আমাদের এখানে স্বাধীনতার পরে যেটুকু যা সমবায়, তার সবই রাষ্ট্র করে দিয়েছে। সরকারি সমবায়, সরকারই সব ব্যবস্থা করে দেয়, এক জন সরকারি অফিসার থাকেন, তিনি দেখাশোনা করেন, এই রকম। আমার মনে হয়, এখানে একটা কালচারের প্রশ্ন আছে।
এখানে তো রাজনীতি একটা ভূমিকা নিতে পারত।
হয়তো পারত, কিন্তু... আমি এ নিয়ে এক কালে বিনয়বাবুর (বিনয় চৌধুরী) সঙ্গেও কথা বলেছি। তিনিও সমস্যাটা অস্বীকার করতেন না। বলতেন, সমবায় এখানে করানো যায় না, সমবায় এখানকার চাষিদের ধাতে নেই। একসঙ্গে কিছু করতে গেলেই হাজার সমস্যা, রেষারেষি, এ ওটা কম পেল, ও ওটা বেশি পেল, এই সব শুরু হয়ে যায়। এর পিছনে হয়তো একটা জিনিস কাজ করেছে। জমির ব্যক্তিগত মালিকানার নিরাপত্তা এখানে এতটাই কম ছিল যে, সব সময় লোকে মনে করেছে, এই বোধ হয় আমার জমিটা নিয়ে নেবে। মালিক হিসেবে যে আত্মবিশ্বাস থাকলে আর পাঁচটা মালিকের সঙ্গে সমবায় গড়ে তোলা যায়, সেটা এখানে ছিল না।
তা হলে এই পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের কী হবে?
খুব কিছু আশা করার কারণ তো দেখছি না। প্রথমত, কেন্দ্রের সঙ্গে এই ঝগড়াটা যদি জারি থাকে, তা হলে তো এই যে দানসত্রের রাজনীতি, এটাও বেশি দিন চালানো যাবে না। এখনই তো লোকজন বলতে শুরু করেছে, এত কিছু দেবে বললে, কই, পেলাম না তো! এখন, রাজস্ব না বাড়ালে তো কিছুই হবে না।
পশ্চিমবঙ্গে নিজের রাজস্বের ভিত তো খুবই দুর্বল।
একেবারেই। দ্বিতীয়ত, বিজেপি এখন মনে করছে, পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম, এই দুটো রাজ্যে তারা যথেষ্ট শক্তি বাড়াতে পারবে।
মনে করার যথেষ্ট কারণও আছে।
নিশ্চয়ই। এবং এটা যদি সত্যি হয়, তা হলে, ভারতের অন্যান্য জায়গাতে হোক বা না হোক, পশ্চিমবঙ্গে কমিউনাল ব্যাপারটা বাড়বে বলেই আমার আশঙ্কা। এবং তৃণমূল যত বলবে, আমি একটিও মুসলিম ভোট হারাতে পারব না, তত বেশি করে হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে যাওয়ার প্রবণতা বাড়বে। পোলারাইজেশনটা তা হলে উত্তরোত্তর বেড়ে চলবে। আমার কাছে এটা একটা বড় আশঙ্কা। স্বভাবতই, এর ফলে হিংসার মাত্রাও বাড়ার ভয় আছে। আর একটা আশঙ্কা হল, দলগুলো নিজেদের লোকের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না। এই যে চটকলের ঘটনাটা, এ তো সেটাই দেখিয়ে দেয়। এবং এখন আর কেবল একটা শাসক দলের ব্যাপার নয়, বিভিন্ন এলাকায় সেই দলের মধ্যে একাধিক গোষ্ঠী। আর তার ফলে পুলিশ এবং প্রশাসনের সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়তা। এ রাজ্যে পুলিশের এখন এটাই প্রায় নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেখানে যে যা করছে করতে দাও, ঢুকতে যেয়ো না, কারণ ঢুকতে গেলেই একটা না একটা গোষ্ঠীর কুনজরে পড়তে হবে। ফলে নিষ্ক্রিয় থাকাই চাকরি বাঁচানোর এবং নিজের বাঁচার একমাত্র রাস্তা!
এটা ঠিক আগের মতো নয়।
আগে তো বলে দেওয়া হত, এটা কোরো, এটা কোরো না। এটা অন্য রকম। এর ফলে আইনশৃঙ্খলার যেটুকু মেশিনারি ছিল, সেটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগের কারণ।
(শেষ)