কানাডার বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী, শরবিদ্ধ জাস্টিন ট্রুডো, বড়দিনের ছুটি কাটাতে গিয়ে জীবনের শেষ (সম্ভবত) বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিলেন। প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক সন্ন্যাসের কথা ঘোষণা করে জানালেন, এর পর কী করবেন তা ভাবার সময় এখনও আসেনি।
যে কোনও রাষ্ট্রেরই রাজনীতির চলন বিভিন্ন প্রকারের। তার মধ্যে রয়েছে নাগরদোলার ছন্দও। কিন্তু উত্থানের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ার পর, সম্পূর্ণ তলিয়ে যাওয়া কানাডার লিবারাল পার্টিকে টেনে-হিঁচড়ে এক নম্বরে নিয়ে আসার পর, প্রায় এক দশক দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব করে যাওয়ার পরেও কানাডার রাজনীতির অন্যতম এই নায়কের পরবর্তী ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করে লেখার সাহস আপাতত কোনও কল্পবিজ্ঞান লেখকও পাবেন না মনে হয়। দেশের ভিতর এবং আন্তর্জাতিক স্তরে একদা তিনি ছিলেন যেমনই নন্দিত, আজ ততটাই নিন্দিত। এ বছরের অক্টোবরে কানাডায় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। তার আগে জোড়া পদত্যাগ করতে হল তাঁকে। প্রশাসন থেকে এবং নিজের দলীয় রাজনীতি থেকেও।
একদা ট্রুডোর ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত ছিলেন কানাডার প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। গত ডিসেম্বরে হঠাৎই পদত্যাগ করেন তিনি। প্রকাশ্যে পদত্যাগের কারণ না জানালেও শোনা গিয়েছিল, নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ট্রুডোর সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণেই মন্ত্রিসভা ছেড়েছেন তিনি। এর সপ্তাহ তিনেক পরেই গত ৬ জানুয়ারি ট্রুডো প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। লিবারাল পার্টির প্রভাবশালী নেতা তথা প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের সঙ্গে সংঘাত ট্রুডোর ইস্তফার অনুঘটক বলে মনে করা হচ্ছে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত এটি সামান্য অনুঘটকই। ট্রুডো আসলে ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদি বাসাবাড়িতে থেকে বুঁদ হয়ে তৈরি করেছিলেন স্বেচ্ছাচারী, স্বখাত-সলিল। এখন কান পর্যন্ত জল উঠে আসায়, অনন্যোপায় হয়ে ছেড়েছেন রাজত্ব। দলের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমছিল হুহু করে। দেশে বেড়ে চলা খাবারের দাম ও বাড়ির দাম, তাঁর প্রতি সমালোচনার পারদ চড়া করে। বেশ কিছু সমীক্ষা দাবি করছিল, আসন্ন ভোটে কানাডায় কনজ়ারভেটিভদের কাছে হারতে পারেন লিবারালরা। তার জেরেই ট্রুডোর উপর চাপ বাড়ছিল। ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের সঙ্গে ট্রুডোর সংঘাতও বেড়েছিল। সেই মর্মে দলীয় রাজনীতিতেও কোণঠাসা হচ্ছিলেন ট্রুডো। এরই মাঝে খলিস্তানপন্থী নেতা জগমীত সিংহের দল নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সমর্থন নেওয়ায় সমীকরণ পাল্টায় কানাডার রাজনীতিতে।
অশান্ত সমুদ্রে হাল ধরতে ট্রুডো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভারতকে নিশানা করেছিলেন শেষপর্যন্ত। কানাডার মাটিতে খলিস্তানপন্থী হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যা নিয়ে ট্রুডো ভারতের সঙ্গে কার্যত যুদ্ধই ঘোষণা করেন। মুহূর্তে তা ওটাওয়া-দিল্লির কূটনৈতিক সম্পর্কের সমীকরণে প্রভাব ফেলে। কালক্রমে ভারত এবং পশ্চিমের সম্পর্কে। ২০২৩ সালে ভ্যাঙ্কুভারে মৃত্যু হয় হরদীপ সিংহ নিজ্জরের। ট্রুডো যথেষ্ট প্রমাণ ছাড়াই হইহই ফেলে দেন, ওই হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্টদের হাত ছিল।
ট্রুডো তাঁর অট্টরোল এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন যে, ছবিটা আরও বেশি প্রত্যক্ষ হতে শুরু করেছিল। পঁচিশে ট্রুডোকে নির্বাচনের মুখে দাঁড়াতে হবে। আন্তর্জাতিক সংলাপে উঠে আসছিল অনিবার্য ভাষ্য। পঞ্জাবের পর কানাডাতেই সবচেয়ে বেশি শিখের বাস। যদিও সংখ্যায় তারা কানাডার জনসংখ্যার মাত্র দুই শতাংশ, বা সাত লাখ সত্তর হাজারের কাছাকাছি। তবে দুই শতাংশই কানাডার ঘরোয়া রাজনীতিতে অন্তত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৩৪০ আসন বিশিষ্ট কানাডার সংসদে ট্রুডোর লিবারাল পার্টির দখলে ছিল ১৬০টি আসন, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতার থেকে ১০টি কম। সে দেশের সংসদের ৩৪০ আসনের ২০টির ভাগ্য নির্ধারিত হয় এশীয়দের ভোটে। তার মধ্যে ১৯টিতে শেষ কথা শিখরা। ট্রুডো এই ১৯টি আসনকে পাখির চোখ করেছেন বলেই নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে তাঁর তর্জন, এ কথা ভারতীয় কূটনীতিকরা সফল ভাবেই বোঝাতে পেরেছিলেন আন্তর্জাতিক শক্তিকেন্দ্রগুলিতে। এ কথাও আমেরিকা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল (বিশেষ করে ট্রাম্পপন্থীরা) কানাডার শিখদের সিংহভাগই খলিস্তানপন্থী এবং তারা প্রেরণা ও অর্থ জুগিয়ে ভারতীয় শিখদের ফের অস্ত্র হাতে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামতে উস্কানি দিচ্ছে। স্বভাবতই কানাডায় শিখদের নাগরিকত্ব এবং প্রতিষ্ঠা পাওয়া তুলনায় অনেক সহজ। নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রুডোর বিচলিত হওয়ার পিছনে নির্বাচনী সমীকরণটিই আসল বলে প্রতিভাত হয়েছিল।
নিরাপত্তা বিষয়ে পাঁচ দেশের মঞ্চ ফাইভ আইজ়, কোয়াডের সদস্য অস্ট্রেলিয়া, জাপান, আমেরিকা এবং ব্রিটেনকেও নিজ্জর হত্যায় ভারতের বিরুদ্ধে নালিশ করে ট্রুডো প্রশাসন। কোনও দেশই ট্রুডোর তথ্যপ্রমাণে সন্তুষ্ট হয়নি। ফলে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে ‘মিশন নিজ্জর’-ও ভূপতিত হয়।
পরিণামে ট্রুডোর এই মহানিষ্ক্রমণ নেহাতই খোরাক হয়ে ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে গেল আন্তর্জাতিক সমাজমাধ্যমে নেটিজ়েনদের মধ্যে। কোথাও দেখা যাচ্ছে কুর্সিসুদ্ধ ট্রুডোকে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছেন গোমড়ামুখো ট্রাম্প! বলা হচ্ছে, ট্রাম্পের বিজয় ট্রুডোর রাজনৈতিক জীবন শেষ করে দিল। আবার কোথাও ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে, প্রাসাদের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে পোডিয়ামে দাঁড়াচ্ছেন ট্রুডো। কিন্তু সেখানে রাখা তাঁর বক্তৃতার পাতাগুলো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে অলক্ষুণে বাতাস। শূন্য চোখে চেয়ে দেখছেন তিনি।
ঠিকই তো! সময় থাকতে বাতাসের লক্ষণ বুঝতে পারেননি কানাডার এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ এই নেতা।