প্রদীপ হাতে মীরাবাই। মেবার চিত্রকলা, রাজস্থান, ১৮৩৮। (ডান দিকে) বেণুগোপাল কৃষ্ণ। সিস্ট পাথর, পশ্চিমবঙ্গ/ বাংলাদেশ, ১৭ শতক। বই থেকে
এক সহায়সম্বলহীন বিধবা রমণী হালিশহরে নন্দগোপালজিউয়ের সেবায়েত ছিলেন। কষ্টিপাথরের বিগ্রহকে নিয়েই ছিল তাঁর সংসার। অর্ধশতাব্দীরও বেশি আগে হালিশহরে ক্ষেত্রসমীক্ষায় গিয়ে পাথরের বিগ্রহের প্রতি ওই মহিলার অপরিসীম বাৎসল্যের প্রকাশ দেখে অভিভূত হয়ে যান সমাজবিদ হিতেশরঞ্জন সান্যাল। তাঁর কথায়, ‘দেবতাকে, তাঁহার মহিমাকে উপলব্ধি করিবার জন্য তাঁহাকে রাজরাজেশ্বর সম্রাট বলিয়া ভাবিবার প্রয়োজন হয় নাই— আপন গৃহকোণে পরিবার পরিজনদের মধ্যেই বাঙ্গালী তাঁহার সন্ধান পাইয়াছে, পূজা করিয়াছে, ভালবাসিয়াছে। এই ভালবাসার আকর্ষণ এত ব্যাপক হইয়া উঠিয়াছিল যে গৃহদেবতা প্রতিগৃহে অতি আদরণীয় পরিজনের স্থান লাভ করিয়া নিলেন।’ (বাংলার মন্দির)
পঞ্চাশ বছর পরে ছবিটা খুব পাল্টেছে কি? আজও বাংলায় অনেক পরিবারেই গোপাল বাড়ির শিশুর মতোই পরিচর্যা পান, ভয়ঙ্করী কালী মা/কন্যারূপে কল্পিত, মা দুর্গা আশ্বিনে পুজোর সময় সিংহ আর রক্তাক্ত মহিষাসুরকে নিয়েই ‘বাপের বাড়ি’ আসেন। শুধু বাংলা কেন, মথুরা-বৃন্দাবনকেন্দ্রিক উত্তর ভারত ও রাজস্থানে শিশু ও কিশোর কৃষ্ণ একই রকম দুরন্ত, মহারাষ্ট্রে তেমনই আত্মীয়তা ‘গণপতি’র সঙ্গে। দক্ষিণের ঠাকুরঘরেও নানা দেবদেবীর স্থায়ী আসন। গৃহকোণের বাইরে দেশ জু়ড়ে ছোটবড় মন্দিরে স্থাপিত অজস্র ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী— কোথাও তা স্বয়ম্ভূ, কোথাও বা পূজার জন্য প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেই মূর্তিতে। স্থায়ী মূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে নতুন করে তা তৈরি হয়, আবার বছরের নির্দিষ্ট সময় পুজোর জন্য আছে আর এক ধরনের মূর্তির আবাহন-বিসর্জন। গ্রামে গ্রামান্তরে রয়েছে লোকায়ত দেবকুল, যাদের অনেকেরই নির্দিষ্ট কোনও প্রতিমা নেই। কাউকে ক্রমে গ্রাস করেছে মূলস্রোত, কেউ বা নিজ মহিমায় অটল। হিন্দুধর্মে ভক্তির পথ অনেকান্ত, শিল্পভুবনে তার প্রকাশ বহুবিচিত্র। তুলনায় বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম অনেকটাই একমুখী, তবু শিল্পকলায় অবশ্যই তারা স্বপ্রভ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মূর্তিপূজা, বা বিগ্রহের সেবায় এই ভক্তির প্রকাশ কত দিনের? বেদে ‘পূজা’ নেই, সে যুগে ধর্মাচারের কেন্দ্রে ছিল যাগযজ্ঞ ও বলিদান। ‘পূজা’র উল্লেখ প্রথম মেলে ‘মহাভারত’ ও ‘গৃহ্যসূত্রে’। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই মোটামুটি হিন্দু ধর্মাচার তার সুপরিচিত চেহারায় স্থিতি পায়, যে সময় মহাবীর ও বুদ্ধ বৈদিক যাগযজ্ঞের বিরোধিতা করে নতুন ধর্মের প্রচার করছেন। ‘ভগবদ্গীতা’য় ভক্তিকেই উৎকৃষ্ট পন্থা বলা হয়েছে, ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’। ভক্তের মনোবা়ঞ্ছা পূরণের জন্য শাস্ত্র যে সব আচার-আচরণীয়ের নির্দেশ দিল সেখানে মূর্তি-বিগ্রহের স্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ধর্মগ্রন্থ পড়া বা শোনা নয়, ভক্ত চায় অরূপের মধ্যে রূপের সন্ধান করতে। ‘প্রতিমা’র দর্শনেই ভক্তের শান্তি। সে প্রতিমা গৃহকোণে, মন্দিরে, পথের ধারে গাছতলার থানে কিংবা বিশেষ তিথির শোভাযাত্রায় যেখানেই থাকুক না কেন। গৃহকোণে যে দেবতা প্রাণের দুলাল, মন্দিরে কি শোভাযাত্রায় তাঁরই ‘ঝাঁকিদর্শনে’ ভক্ত সন্তুষ্ট। তাই সে সব দেবতার নানা রূপের প্রতিমা নির্মাণেই ভারতশিল্পের পরাকাষ্ঠা।
হিন্দু ধর্মাচার ভারতে এখনও একই রকম সজীব, বিশ্বায়নের স্রোতে তা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বহু দেশে, শিকড় নামিয়েছে সেখানেও। জৈন ধর্ম মূলত ভারতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম মূলত ভারতের বাইরে কিছু দেশে বেশি সক্রিয়। পৃথিবী জুড়ে বহু সংগ্রহশালায় এই তিনটি ভারতীয় ধর্মের আড়াই হাজার বছরের ধারাবাহিকতা থেকে হাজারো শিল্পনিদর্শন ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু সেখানে থরে থরে সাজানো দেবদেবীর মূর্তি আর তার সামান্য পরিচিতি দেখলে কি সাধারণ দর্শকের বোঝা সম্ভব উপাস্যের সঙ্গে উপাসক কোন সূত্রে গাঁথা? বিশেষ করে বিদেশের সংগ্রহশালায়। শিল্প-গবেষকরা ব্যস্ত থাকেন মূর্তিতত্ত্বের খুঁটিনাটি নিয়ে, ইতিহাস-গবেষক চান কালনির্ণয় করতে, আর দর্শক বড়জোর মুগ্ধ হয়ে দেখেন বিস্ময়কর তক্ষণকলার নমুনা। আসলে সকলেই নির্দিষ্ট বর্গে স্থাপন করতে চান নিদর্শনটিকে। দর্শক বুঝতেই পারেন না, বিশেষ সময়ের সৃষ্টি হলেও ভক্তের দৃষ্টিতে তা কালাতীত। দর্শক জানতে পারেন না কী ছিল তার প্রেক্ষিত, পারিবারিক ঠাকুরঘর না প্রকাশ্য মন্দিরের গর্ভগৃহে ছিল তার অধিষ্ঠান, না কি উৎসবমূর্তির মতো তাকে দেখা যেত শহরের পথে শোভাযাত্রায়? কী কী উপচারে তার পূজা করা হত, সাজসজ্জাই বা কেমন ছিল। আবার বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি আর পুথিচিত্রের ছিন্নপত্র যখন বিচ্ছিন্ন ভাবে প্রদর্শিত হয় তখন কি বোঝা যায় কোনও ভক্ত— তা তিনি যে ধর্মেরই হোন না কেন— তাঁর উপাস্যের জন্য লিপিকরকে দিয়ে অনুলিখন করিয়ে শিল্পীকে দিয়ে সেটি বহু যত্নে চিত্রিত করিয়েছিলেন? রাজস্থানের নাথদোয়ারা-য় শ্রীনাথজির ‘পিছোয়াই’ যে বিগ্রহের পিছনে টাঙানোর জন্য আঁকা, কিংবা পুরী কি কালীঘাটের পট যে লোকে সংগ্রহ করে নিয়ে যেত মন্দির দর্শন করতে এসে, এ সব কথা কী করে বোঝা যাবে শুধু সেই সব নিদর্শন দেখে?
বিষয়টি গভীর ভাবে ভাবিয়েছে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও হিমালয়ের শিল্পসংস্কৃতি বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ প্রতাপাদিত্য পালকে। কর্মসূত্রে মিউজিয়ম অব ফাইন আর্টস, বস্টন, লস এঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়ম অব আর্ট, আর্ট ইনস্টিটিউট অব শিকাগো, গেটি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের মতো বহু বিশিষ্ট সংগ্রহশালার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল, অধ্যাপনা করেছেন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সতেরো বছর শিল্পপত্র ‘মার্গ’ সম্পাদনা, আমেরিকায় ভারতীয় শিল্পের বহু প্রদর্শনীর রূপকার, সত্তরের উপর বই ও ক্যাটালগ প্রণেতা প্রবীণ এই শিল্পতাত্ত্বিক এ বার তাই রূপায়িত করেছেন সম্পূর্ণ অন্য ভাবনার এক প্রদর্শনী। ক্যালিফর্নিয়ার সান্তা বারবারা মিউজিয়ম অব আর্টের ৭৫ বছর পূর্তি উৎসবের অঙ্গ হিসেবে সেখানে এখন প্রদর্শনীটি চলছে। প্রদর্শিত ১৬৬টি শিল্পনিদর্শনের অর্ধেকের বেশি এসেছে মিউজিয়মের স্থায়ী সংগ্রহ থেকে, অন্যগুলি নানা ব্যক্তিগত সংগ্রহের। বস্তুত লস এঞ্জেলেস কাউন্টি মিউজিয়ম অব আর্টে ১৯৭০ সালে আয়োজিত বিখ্যাত হিরামানেক সংগ্রহের প্রদর্শনীর পর সম্ভবত এই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের এত বড় ও বৈচিত্রপূর্ণ শিল্পসম্ভার আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে দেখানো হচ্ছে। এই উপলক্ষে প্রতাপাদিত্য পালের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে একটি ক্যাটালগ (পূজা অ্যান্ড পায়েটি/ হিন্দু, জৈন অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট আর্ট ফ্রম দি ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফর্নিয়া প্রেস), যেখানে সম্পাদক ছাড়াও হিন্দু-জৈন-বৌদ্ধ তিন ধর্মের ভক্তি ও শিল্প পরম্পরা নিয়ে যথাক্রমে লিখেছেন স্টিফেন হাইলার, জন কর্ট ও ক্রিশ্চিয়ান লুকজানিটস, আছে প্রতিটি প্রদর্শের ছবি ও বিবরণ, আর শেষে দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় তৈরি করে দিয়েছেন পারিভাষিক শব্দের ব্যাখ্যা।
বইয়ের শুরুতেই প্রতাপাদিত্য পালের সুদীর্ঘ প্রবন্ধটি বিষয়ের সামগ্রিকতার সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেয়। পূজা ও ভক্তি কেন্দ্রিক এই প্রদর্শনীর কালসীমা কমবেশি দু’হাজার বছর, ভৌগোলিক সীমা ভারতীয় উপমহাদেশ আর প্রদর্শবস্তু পৃথিবীর তিনটি প্রাচীন ও অন্যতম প্রধান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। প্রতিটি ধর্মের তত্ত্বে পার্থক্য অনেক, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভক্তির প্রকাশে সকলেরই অবলম্বন প্রতীক ও প্রতিমা। বস্তুত ভারতীয় ধর্মাচরণ থেকে যদি ‘প্রতিমা’কে বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তা হলে পড়ে থাকে শুধুই নিরবয়ব তত্ত্বকথা, সাধারণ ভক্তজনের কাছে যা নিরর্থক। অনেক ভাল ভাল কথায় বোঝাতে না পেরে শেষমেষ তো শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ‘বিশ্বরূপ’ দর্শন করালেন। তাই ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাগৈতিহাসিক ও আদি-ঐতিহাসিক পর্বের অব্যাখ্যাত নানা প্রতীক থেকে ঐতিহাসিক পর্বের বিভিন্ন স্পষ্ট ধর্মীয় প্রতীক হয়ে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবী, বুদ্ধ-বোধিসত্ত্ব, জিন-তীর্থঙ্করের মূর্তিতে ক্রমবিবর্তনের চলচ্ছবিতে ভক্তমনের আশ্চর্য ইতিহাস ধরা পড়েছে। শুধু মূর্তিবিগ্রহ কেন, ছবিও কি কম গুরুত্বপূর্ণ? প্রতিষ্ঠিত মূর্তির পরিবর্তে ঘটে‘পটে’ পূজার বিধান তো শাস্ত্রেই আছে। পুথিপাণ্ডুলিপির ছবি থেকে পটচিত্র কি পিছোয়াই, তাঞ্জোর চিত্রকলা থেকে রবি বর্মার প্রিন্টও এক বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা। আধুনিক ঠাকুরঘরে, তা সে ভারতের যে কোনও প্রান্তেই হোক, নানা দেবদেবী এবং গুরুদেবের রঙিন ছাপা ছবি থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
উপমহাদেশের সজীব ধর্মজীবনের সঙ্গে সংগ্রহশালার ঠান্ডাঘরে রাখা জীবনবিচ্ছিন্ন শিল্পনিদর্শনকে মিলিয়ে দেখানর যে চেষ্টা সান্তা বারবারার এই প্রদর্শনী ও প্রকাশনার মাধ্যমে করা হয়েছে তা সত্যিই অভিনিবেশের দাবি রাখে। আমাদের দেশে অবশ্য উল্টো স্রোত। কোনও পুরনো মূর্তি হঠাৎ মাটি খুঁড়তে গিয়ে বা পুকুর থেকে উদ্ধার হলে সঙ্গে সঙ্গে তেল-সিঁদুর লেপে তার পুজো শুরু করে দিই আমরা, ক’দিনের মধ্যেই গড়ে ওঠে মন্দির। শিল্প হিসেবে তার কোনও মর্যাদা রাখা হয় না। আর আমাদের সংগ্রহশালার দর্শকরা যে খুব শিকড়সম্পৃক্ত তা-ও নন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ সংগ্রহশালার শতবার্ষিকী প্রদর্শকক্ষে ‘দৈনন্দিনের শিল্প’ প্রদর্শনীর অঙ্গ হিসেবে বাঙালির ঠাকুরঘরের একটি প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছে। ভারতীয় সংগ্রহশালা এখন সারা বছরই নানা অনুষ্ঠানে দর্শকদের শিল্পনিদর্শনের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সমগ্রত আমাদের এখনও এ পথে অনেক দূর হাঁটতে হবে।