ছবি: সংগৃহীত
তেত্রিশ কোটি’র হীনতা আজ নেই। এই দেশ ১৩০ কোটির জনমতে বলীয়ান। তবুও ‘ঐ দ্যাখো প্রভাত উদয়’ এর আকাশ গুমোট। সিএএ বিরোধিতার স্লোগান দিয়ে ভাড়া ঘর ছাড়তে বাধ্য হলেন আইনজীবী মহিলা ও তাঁর সঙ্গী। ঘোষিত ও নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একছন্দে ক্ষোভ ও প্রতিবাদে শামিল। ক্রোনোলজি বোঝার আদেশ এসেছে আগেই। চলছে প্রতিবাদের ভাষা বনাম আনুগত্যের ভাষার লড়াই। নীতিগত অবস্থানের সঙ্গে অযৌক্তিক সমর্থনের দ্বন্দ্ব। চারপাশের মতান্ধদের ভিড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন একদল মহিলা— রাধিকা ভেমুলা, ফতেমা নাসিমা, শর্মিষ্ঠা ঘোষ এবং নির্ভয়ার মায়েরা। ওঁরা সকলেই নিজের সন্তানের যন্ত্রণায় বিদ্ধ। তবুও কান্না মুছে প্রতিবাদের রাস্তায় অটল। ঘর ছেড়ে ‘নেশন বিল্ডিং’-এর রাজপথে নেমেছেন তাঁরা।
রাধিকা ভেমুলা হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত ছেলেকে হারিয়েছেন। জানতেনও না ছেলের উপর নেমে এসেছে বিপদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে রোহিতের প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ও সাসপেন্ডের নির্দেশ দেওয়া হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারি পয়সা। তবুও রাধিকা ছেলের ধার করা পয়সা পেতে থাকেন নিয়মিত। তার পরে এক দিন মানসিক অত্যাচার ও আর্থিক প্রতিরোধের সামনে রোহিত আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। রাধিকা সন্তান হারান। দেশও হারায় রোহিত ভেমুলাকে।
জাতিবঞ্চনা ও সামাজিক অত্যাচারের শিকার ছিলেন রাধিকা। সেলাই মেশিনের পাশাপাশি ছেলের মেধাবৃত্তির ২৫ হাজার টাকা ছিল বড় ভরসা। ছেলের আত্মহত্যার পরে রাধিকা ছেলের অধরা স্বপ্নপূরণের পথে হাঁটেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতি বৈষম্যের অবসান হোক, এই বক্তব্যে অনড় থাকেন। রোহিতের মৃত্যুদিন ‘রোহিত শাহাদাত দিন’ হিসেবে পালন করে অম্বেডকর স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন। রাধিকার কাছে তো প্রতিদিন শাহদাত। সব দলিত ছাত্রদের মধ্যে রোহিত ভেমুলাকে খুঁজে বেড়ানোর অঙ্গীকারে তাঁর দিন শুরু হয়। প্রকাশ্যে নির্ভয়ে ঘোষণা করেন, রোহিতকে তারাই মেরেছে যারা নাজিবকে মেরেছে। অসহায়ের বড় শক্তি হয়ে ওঠেন রাধিকা।
ফতেমা নাসিমার কাহিনি মর্মন্তুদ। ছেলে নাজিব আহমেদ জীবিত না মৃত তাই তিনি জানেন না। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাজিব গায়েব হয়ে গেলেন। এক সন্ধ্যায় কেউ কেউ তাঁকে অটোরিকশায় উঠতে দেখেছিলেন। তার পরে তিনি আর হস্টেলে ফেরেননি। মা ফতেমা আদালত থেকে সিবিআই দফতরে ধর্নায় বসছেন লাগাতার। কিন্তু সুরাহা হয়নি। ছেলের অন্তর্ধান রহস্যের গিঁট খোলেনি। ফতেমা ছেলের ছবি ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় ঘুরেছেন। পুলিশ টেনে-হিঁচড়ে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ফতেমার একটিই কথা— নাজিব কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ফতেমা তদন্তের দাবি জানালে নাজিবের বিরুদ্ধেই মারামারির অভিযোগ আসে। ফতেমা তা মেনে নিয়ে দাবি করেছিলেন, নাজিব কাউকে চড় মারলে ভারতের সংবিধান চড়ের শাস্তি হিসেবে কী বিধান দিয়েছে? এমনকি নাজিবের ডিপ্রেশনের ভোগার সংবাদের তীব্র বিরোধিতা করেন নাসিমা। নাজিবের হারিয়ে যাওয়ার কারণের সঙ্গে অপরাধের যোগ খুঁজতে ব্যর্থ সিবিআই ‘কেস ক্লোজ’ করার প্রার্থনা করলেও ফতেমা আবার সিডিআর (কল ডাটা রেকর্ড) চান। সেটাও তিনি পেতে ব্যর্থ হন। তবুও, নাজিব কোথায়— এই প্রশ্নকে এক জাতীয় প্রশ্নে পরিণত করতে সমর্থ হন ফতেমা নাসিমা। এক বিশাল সংখ্যক ছাত্রদের আম্মি হয়ে যান ফতেমা।
এখন রাধিকা ও ফতেমার সঙ্গে এক নতুন মুখ শর্মিষ্ঠা ঘোষ। ডজন খানেক সেলাই মাথায় নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে রয়েছেন কন্যা ঐশী। একদল মাস্কপরা অপরিচিত মানুষদের হাতে জওহরলাল ইউনিভার্সিটির অভ্যন্তরে মেয়ে আক্রান্ত হয়েছেন জেনে শর্মিষ্ঠা উদ্বিগ্ন, তবে ভীত নন। দেশ তোলপাড় করা প্রতিবাদ মিছিলে শর্মিষ্ঠা নিজে পা মেলান। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তোলেন। শর্মিষ্ঠা ঘোষ শুধু ঐশীর মা নন, বাড়ি ছেড়ে দূরে পড়তে যাওয়া সব মেয়েদের বড় ভরসা। ছাত্রদের সার্বিক সমস্যার সঙ্গে একাত্ম সেই মা। এত দিন মায়েরা মেয়েদের নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে বলতেন। আঁচলের ছায়া সরিয়ে আজ সেই মায়েরা লড়াইয়ের ময়দানে হার মেনে ফিরে আসার প্রশ্নে আপত্তি জানাচ্ছেন। শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের সামনে টিকে থাকার পরামর্শ দেওয়া মায়েরা আজ শর্মিষ্ঠা ঘোষের ন্যায়ের দাবি শুনছেন। এই আহ্বানে এক অসীম শক্তি আছে। অনেক জড়তা ও পিছুটান পেরিয়ে আসার মুহূর্ত তৈরি করে দিলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ।
সব নকল নাম ছুড়ে ফেলে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এক মা নিজের মেয়ের নামপ্রকাশ করেছিলেন। তিনি দিল্লিতে গণধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার মা। বিচার চাইতে চাইতে মরে যাওয়া মেয়েকে দেখে মাঠে নেমেছিলেন তিনিও। অভিযুক্তের এক জন ছাড়া পেলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু সরকারের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন অভিযোগের তির। ফাঁসির দাবিতে ছিলেন অনড়। মেয়ের এমন মৃত্যুতে তাঁর তীব্র যন্ত্রণা দেশের মানুষের চোখে জল এনে দিয়েছিল।
সেই মায়ের দাবি মুহূর্তে সবার দাবি হয়ে উঠেছিল। সমস্ত অত্যাচারিত মেয়েদের মায়েদের মুখ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। দিল্লি কাণ্ডের প্রতিবাদের সভা ও মিছিলে নিজে উপস্থিত থেকে তিনি মেয়েদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে সওয়াল করেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার দাবি জানাতে থাকেন। সকলের কাছে প্রতিবাদ জারি রাখার আকুতি জানান। সরকারের কাছে মেয়েদের নিরাপত্তা আদায়ের প্রতিশ্রুতিতে মায়েদের অনড় থাকতে শিখিয়েছিলেন নির্ভয়ার মা।
এক মা এ ভাবেই এক সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের জন্ম দেন। ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে দেশের হাল-হকিকতের দিকে নজর দিতে শুরু করেন। ঘরের সমস্যাকে দেশের সমস্যার সঙ্গে জুড়ে দেখার দর্শন তৈরি করেন। এই মায়েরা নতুন ভারতের মা। প্রকৃত অর্থে এঁরা কেউই উচ্চশিক্ষিত বা চাকরিজীবী নন। নিজেদের পরিবার চালাতে বা সামান্য উপার্জনের খোঁজে তাঁরা দিনরাত ব্যস্ত। শুধুমাত্র ঘটনার আকস্মিকতায় তাঁরা এক রাস্তায় এসে দাঁড়ান। দেশের অরাজকতা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে ওয়াকিবহাল হতে থাকেন। কর্তৃপক্ষ বা সরকারের দিকে সরাসরি আঙুল তুলে বিচারের দাবি জানাতে থাকেন। দেশ গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও নেতাদের মুখ চেয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে আগেই।
এই মায়েরাই আজ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়েন সমর্থকেরা। ওঁরা সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলতে শেখাচ্ছেন। ওঁরা চাইছেন, স্বপক্ষের আজ্ঞাবাহক নয়, প্রতিবাদের দাসত্ব করুক পরিবারের সন্তান। মায়েরা তাই নিজেদের হারানোর যন্ত্রণা ভুলে অন্দরমহলের বাইরে নিজেদের বিলিয়ে দিচ্ছেন। জনসমুদ্রের বিপুল সমাবেশে মা শুধুই অভিভাবক নন, বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থার বিরুদ্ধে পথপ্রদর্শকও। অন্যায়ের প্রতিকার হোক। সুবিচার ফুলের মতো জীবনকে সুন্দর করুক। ক্ষমতার অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সব কালো হাত দৃশ্যমান হোক।
শিক্ষিকা, রঘুনাথগঞ্জ হাইস্কুল