নারী শিক্ষার প্রসারকে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার অন্যতম হাতিয়ার মনে করা হয়। লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে আরও সচেতন হবেন এবং শ্রমের বাজারে তাঁদের যোগদান করার সুযোগ বাড়বে। ধরা হয়, কাজের মাধ্যমে আর্থিক স্বাবলম্বন নিশ্চিত হলে নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং তাঁর সামাজিক উত্তরণ ঘটবে। এই লক্ষ্যপূরণ করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল, মাধ্যমিক স্তরে, বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের স্কুলছুটের প্রবণতা। এই স্কুলছুট মেয়েদের অধিকাংশই গৃহস্থালির কাজে হাত লাগায়। এর পরেই শুরু হয় তাকে পাত্রস্থ করার প্রক্রিয়া। যে সন্তান নিজের কাছে বেশি দিন থাকবে না, তার শিক্ষায় বিনিয়োগ করার বদলে তাকে ‘গৃহকর্মে নিপুণা’ করে তুললে বিয়ের বাজারে তার কদর বাড়বে, মনে করেন অনেক বাবা-মা।
প্রধানত এই ধরনের সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৩-১৪ সালে কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পে স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের তেরো বছর বয়স থেকে বছরে এক হাজার টাকা অনুদান দেওয়া হয়, আঠারো বছর বয়স হলে তারা পায় এককালীন পঁচিশ হাজার টাকা। শর্ত হল, তাকে ওই বয়স পর্যন্ত অবিবাহিত থাকতে হবে এবং প্রথাগত বা বৃত্তিমূলক পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে। এ ধরনের প্রকল্পকে ‘কন্ডিশনাল ক্যাশ ট্রান্সফার’ বা শর্তাধীন নগদ হস্তান্তর প্রকল্প বলা হয়। এতে এক দিকে যেমন মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রণোদনা দেওয়া হয়, অন্য দিকে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে আটকানো যায়।
কন্যাশ্রী প্রকল্প কি কিশোরী মেয়েদের স্কুলে থাকার মেয়াদ বাড়াতে পেরেছে? এবং স্কুলে থাকার ফলে প্রাপ্ত শিক্ষার মান কি তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে? কন্যাশ্রীর দেশ-বিদেশের স্বীকৃতির নিরিখে এই দু’টি প্রশ্নেরই উত্তর ইতিবাচক হওয়া উচিত। কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত মেয়েদের সাফল্য-কথা প্রায়ই সংবাদে আসে। খবরে প্রকাশ, কিছু দিন আগেই মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক বিমানবালার দেখা হয়, যিনি এই প্রকল্পের সাহায্যে লেখাপড়া শেষ করতে সমর্থ হয়েছেন। কন্যাশ্রী আর মেয়েদের ক্ষমতায়নের মধ্যে এমন গাঁটছড়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি। কিন্তু সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিমাপ ছাড়া কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রভাব সম্পর্কে নির্দিষ্ট ধারণা করা কঠিন।
এই লক্ষ্যেই আমরা ‘অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট’-এ (সংক্ষেপে ‘অসর’) সংগৃহীত পশ্চিমবঙ্গের তেরো থেকে ষোলো বছর বয়সি বয়ঃসন্ধিকালীন মেয়েদের স্কুলে নাম নথিভুক্তিকরণ ও শিক্ষার মান বিশ্লেষণ করে দেখেছি। আমাদের গবেষণার সময়কাল ছিল ২০০৮ থেকে ২০১৮ অর্থাৎ, কন্যাশ্রী শুরু হওয়ার আগের এবং পরের পাঁচ বছর। ‘অসর’ সমীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হয় প্রায় ছয় লক্ষের মতো শিশু এবং কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স তিন থেকে ষোলো বছর। সমীক্ষায় এদের প্রত্যেকের স্কুল নথিভুক্তির তথ্য, এবং অঙ্ক ও ভাষা জ্ঞানের কিছু মৌলিক পরীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করা হয়। যেমন, ভাষার ক্ষেত্রে দেখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণির পাঠ্যের সমতুল্য শব্দ বা অনুচ্ছেদ ছেলেমেয়েরা অনায়াসে পড়তে পারছে কি না। অঙ্কের পরীক্ষায় দেখা হয়, উত্তরদাতা দুই ডিজিটের সংখ্যা চিনতে পারছে কি না, সংখ্যা হাতে রেখে বিয়োগ, এবং তিন-ডিজিটের সংখ্যাকে একটি সংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে পারছে কি না। ভাগ করতে পারাই সর্বোচ্চ কুশলতা।
কন্যাশ্রী প্রকল্প কিশোরীদের স্কুলশিক্ষার ওপর কী প্রভাব ফেলেছে তা বোঝার জন্য আমরা ‘অসর’ থেকে পশ্চিমবঙ্গের ১৩-১৬ বছরের মেয়েদের বেছে নিয়েছিলাম। কন্যাশ্রী শুরুর আগে এবং পরে, এদের স্কুল নথিভুক্তি এবং পরীক্ষার নম্বর আমরা তুলনা করেছি ওই একই বয়সের মেয়েদের সঙ্গে, যারা পশ্চিমবঙ্গের লাগোয়া রাজ্যে থাকে— যেমন অসম, ওড়িশা এবং ত্রিপুরা। পরে আমরা একই বয়সের ছেলেদের (পশ্চিমবঙ্গে ও ভিন্রাজ্যে) সাপেক্ষেও এই তুলনা করি। ভিন্রাজ্যের মেয়েরা বা কোনও ছেলেরাই কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধে পায়নি। সুতরাং ধরে নেওয়া যায়, পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের স্কুলশিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি ও শিক্ষামানের সঙ্গে বাকিদের যদি কোনও পার্থক্য থাকে, তবে তা হয়েছে শুধু কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রভাবে। প্রকল্প মূল্যায়নের এই পদ্ধতিকে ডিফারেন্স-ইন-ডিফারেন্স বলা হয়।
আমাদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে, স্কুলে মেয়েদের নামের নথিভুক্তি বেড়েছে, কিন্তু আগের চাইতে বেশি শিখছে, এমন নয়। কন্যাশ্রীর পরে গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের স্কুলে অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে গড়ে সাড়ে চার থেকে পাঁচ শতাংশ। যে সব গ্রামে কোনও মাধ্যমিক স্কুল নেই, কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রভাবে সেই সমস্ত গ্রামেও চোখে পড়ার মতো বেড়েছে স্কুল-পড়ুয়া মেয়েদের সংখ্যা। বোঝা যাচ্ছে, স্কুলে মেয়েদের ধরে রাখার লক্ষ্যে কন্যাশ্রী বেশ সফল।
এই সাফল্য আরও স্পষ্ট হচ্ছে অন্য রাজ্যগুলির সঙ্গে তুলনা করলে। কন্যাশ্রী প্রকল্প শুরু হওয়ার আগের পাঁচ বছর এবং তার পরের পাঁচ বছর, এই সময়কালে অসম, ওড়িশা ও ত্রিপুরায় ১৩-১৬ বছর বয়সি মেয়েদের স্কুলে অন্তর্ভুক্তির হার বেড়েছে পাঁচ শতাংশ বিন্দু, পশ্চিমবঙ্গে বেড়েছে সাত শতাংশ বিন্দু। কিন্তু অন্য দিকে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের ফলে শিক্ষার যা উন্নতি হয়েছে, তা হয়েছে সবই পঠনপাঠনের গোড়ার দিকের কুশলতায়। যেমন, অঙ্কের ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে একমাত্র সংখ্যা চেনার ক্ষমতায়। কিন্তু অঙ্কের সর্বোচ্চ কুশলতায় (ভাগের অঙ্ক কষা) চোখে পড়ার মতো অবনতি ঘটেছে। একই ধরনের অবনমন ঘটেছে ভাষাজ্ঞানের ক্ষেত্রে। অনুচ্ছেদ পড়ার ক্ষমতা আগের চাইতে কমেছে। অর্থাৎ গড় ‘লার্নিং আউটকাম’ মন্দ হচ্ছে। সুতরাং কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের স্কুলে নথিভুক্তি বাড়লেও তাদের শিক্ষার মানের উন্নতি ঘটছে না।
এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আমরা দেখছি, কন্যাশ্রী প্রকল্পের পরিণতিতে যে হারে মেয়েদের স্কুলে নথিভুক্তি বেড়েছে খুব সম্ভবত সেই অনুপাতে স্কুলের পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটেনি। আমরা ডিস্ট্রিক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম ফর এডুকেশন (ডাইস) রিপোর্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছি, বেশ কিছু পরিকাঠামো-ভিত্তিক সূচকে এ রাজ্য পিছিয়ে। যেমন মাধ্যমিক স্তরের ক্লাসে টেবিল বা ডেস্ক-এর জোগানে দেশের গড়ের তুলনায় পিছিয়ে আছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে, যেমন ছাত্র-ক্লাসরুম অনুপাতে, এ রাজ্য দেশের তুলনায় ভাল। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও কন্যাশ্রী শুরুর সময় থেকেই এই সূচকের নিরিখে এ রাজ্যের স্কুলের অবস্থার অবনতি হচ্ছে, উন্নতি হচ্ছে না। আন্দাজ করা যায়, অল্প জায়গায় অনেক ছেলেমেয়ে গাদাগাদি করে বসার ফলে পড়াশোনার মান ভাল হচ্ছে না, তারা শিক্ষায় নিরুৎসাহ হয়ে পড়ছে। এর ফলে কমতে পারে স্কুলে উপস্থিতির হার।
‘অসর’ সমীক্ষায় স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতির কোনও তথ্য সংগ্রহ করা হয় না। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ‘অসর’-এর তথ্য ব্যবহার করে স্কুল পরিকাঠামোর সাপেক্ষে শিক্ষার উন্নয়ন বিশ্লেষণ করেছি। আমরা দেখেছি, যে সমস্ত স্কুলে ব্যবহারযোগ্য ব্ল্যাকবোর্ড আছে, বা যে সমস্ত স্কুলে মাস্টারমশাইদের হাজিরা নিয়মিত, সেখানে মেয়েদের পরীক্ষার স্কোর কন্যাশ্রী-পরবর্তী সময়ে ভাল হয়েছে।
আমরা হিসেব করে দেখেছি, কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের পাঁচ শতাংশের মতো স্কুল নথিভুক্তিকরণ বাড়াতে সরকারকে মাসিক মাথাপিছু প্রায় ৪২০ টাকা খরচ করতে হয়। অন্যান্য শিক্ষা-সংক্রান্ত প্রকল্প, যেমন বিহারে মেয়েদের সাইকেল প্রকল্প প্রায় পাঁচ শতাংশ স্কুল নথিভুক্তি বাড়িয়েছিল মাসিক মাথাপিছু সত্তর টাকা খরচে। সুতরাং, কন্যাশ্রী প্রকল্পের এই বাড়তি খরচ তখনই সার্থক হবে, যখন সরকার আরও কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করবে স্কুলের স্থায়ী পরিকাঠামোয়, এবং নজর দেবে প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতায়। পশ্চিমবঙ্গে যখন শিক্ষকদের উপস্থিতি নিয়ে চিন্তাভাবনা হয়, তখন দায়বদ্ধতার দিকে কর্তৃপক্ষের নজর আছে, বোঝা যায়। কিন্তু একই সঙ্গে যখন পরীক্ষার নম্বর দেওয়ার ক্ষেত্রে বানানের গুরুত্বকে লঘু করা হয়, তখন আশঙ্কা হয় যে শিক্ষার মুখশ্রী উজ্জ্বলতর করতে কন্যাশ্রীকে এখনও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে।
প্রসেনজিৎ সরখেল, অর্থনীতি, কল্যাণী ইউনিভার্সিটি; উপাসক দাশ, অর্থনীতি, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টার