জম্মু ও কাশ্মীরে জমির মালিকানা আইন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অধুনা কেন্দ্রশাসিত রাজ্যটিতে আর একটি বড় মাপের পরিবর্তন আসিল। এত দিন কেবল এখানকার স্থায়ী বাসিন্দারা রাজ্যে জমির মালিক হইতে পারিতেন, এখন এই সংশোধনের ফলে দেশের অন্যত্রবাসীরাও এই রাজ্যে জমির মালিকানা পাইবেন। এত দিন যুক্তি ছিল, অন্যরা এখানে জমি কিনিতে পারেন না বলিয়া জম্মু ও কাশ্মীরে বিনিয়োগ নামমাত্র, উন্নয়ন দুষ্কর, ব্যবসাবাণিজ্য কষ্টসাধ্য। নূতন আইন বলবৎ হইলে উন্নয়নে ও বিনিয়োগে কত দূর সাফল্য আসিবে, তাহা ভবিষ্যৎ বলিবে। সেই দিক হইতে ৩৭০ ধারা বিলোপের পর জমির মালিকানা সংক্রান্ত আইন সংশোধন একটি প্রত্যাশিত পদক্ষেপ। জম্মু ও কাশ্মীর যে ভারতের আর পাঁচটি রাজ্য হইতে আলাদা নহে, এবং দেশের অন্যত্র যে যে নিয়মনীতি প্রযোজ্য, এখানেও তাহার ব্যত্যয় হইবার কারণ নাই, ইহাই এই সকল প্রশাসনিক সংস্কারের মূল ভিত্তিবাক্য। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের কার্যক্রমের দিক দিয়াও ইহা সঙ্গতিপূর্ণ, কেননা জম্মু ও কাশ্মীরকে দেশের অন্য রাজ্যের সহিত এক করিয়া দেখিবার ও প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করিয়া তাহা বলবৎ করিবার উদ্দেশ্য এই দলের মৌলিক ভারত-ভাবনার মধ্যেই পড়ে।
অর্থাৎ ‘এক দেশ এক নীতি’ ভারত-ভাবনা অনুয়ায়ী সাম্প্রতিক সংস্কার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, সহজবোধ্য, যুক্তিগ্রাহ্য। প্রশ্ন কেবল দুইটি। প্রথম প্রশ্ন ভিত্তিবাক্যটি লইয়া। সত্যই কি জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবশিষ্টাংশের সহিত একাসনে? সে ক্ষেত্রে কি ভারতীয় সংবিধান তাহাকে ‘বিশেষ মর্যাদা’ দিয়া রাখিয়াছিল নিছক অকারণে? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ইহার মীমাংসার সহিত বর্তমান ও ভবিষ্যতের কার্যবিধির ন্যায্যতা ও বৈধতার প্রশ্নটি গভীর ভাবে জড়াইয়া। ভারতীয় সংবিধান কেবল জওহরলাল নেহরু নামক এক ‘বিপথচালিত’ ব্যক্তির ‘অদূরদর্শিতা’র ফসল নহে, তাহা ভারতীয় ভূখণ্ডের বাস্তব ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি ও শর্তাবলি হইতে সম্মেলক প্রজ্ঞানুসারে উৎসারিত। কাশ্মীরের ইতিহাস যে আলাদা, কাশ্মীরের অধিবাসীদের স্বাধীনতাকালীন অবস্থানের ইতিহাস যে ভারতের অন্যান্য স্থান অপেক্ষা আলাদা— পরিস্থিতির সেই বিচারেই রাজ্যটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হইয়াছিল। তবে আজ সাত দশক পরে সেই ‘মর্যাদা’ বজায় রাখিবার কোনও কারণ আছে কি না, তাহা অবশ্যই একটি গুরুতর প্রশ্ন। কোনও কিছুই চিরস্থায়ী হইতে পারে না, বিশেষ মর্যাদা-ও নহে। উপযুক্ত পথে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে তাহার পরিবর্তন অবশ্যই করা চলে, ভারতের অন্যান্য বহু স্থলে বহু ক্ষেত্রে এমত সংশোধন ও পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে।
কিন্তু তাহা সাধিত হইয়াছে ওই বিশেষ অঞ্চলের অধিবাসীদের, অর্থাৎ অধিবাসী সমাজ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, সম্মতিক্রমে, তাঁহাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। এইখানেই দ্বিতীয় প্রশ্ন। যে পদ্ধতিতে নরেন্দ্র মোদী সরকার জম্মু ও কাশ্মীর সংক্রান্ত আইনবিধি একের পর এক পাল্টাইয়া চলিয়াছে, তাহাতে স্থানীয় অধিবাসীদের সম্মতির চিহ্নমাত্র নাই, এবং যাহাতে সেই কথা আদৌ না উঠে, তদুদ্দেশ্যে সেখানে এখন নির্বাচিত সরকারও নাই। অধিবাসীদের অনিচ্ছা অগ্রাহ্য করিয়া জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ নামক দুইটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করিয়া এই সংস্কারগুলি কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে আনীত হইয়াছে। অর্থাৎ এই সংস্কারগুলি বিধিসম্মত গণতান্ত্রিক মতে আনীত নহে, ভারত নামক গণতন্ত্রের চরিত্রবিরুদ্ধ কেন্দ্রীভূত, কর্তৃত্ববাদী পদ্ধতিতে সাধিত। এই ভাবে একটি অঞ্চলের অধিবাসীদের অগ্রাহ্য করিয়া, তাহাদের মতামত দলিত করিয়া ব্যাপক ও গভীর আইনি পরিবর্তন সাধন— কেবল এই রাজ্যের জন্য ক্ষতিকারক নহে, গোটা দেশের জন্যই বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হইয়া রহিল।