Language

আধুনিকতার পথে অপরিহার্য

আধুনিকতা একটা ঠিকানা নয়, একটা পথ। ‘চলার বেগে পায়ের নীচে’ যে রাস্তা জেগে ওঠে, সেই পথ।

Advertisement

প্রবাল দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২০ ০০:০৪
Share:

গণতন্ত্র বলতে অনেকে বোঝেন, কয়েক বছর অন্তর ভোটের আয়োজন। যাঁদের সংখ্যাধিক্য তাঁদের সিদ্ধান্তটাই স্বীকৃত, এই ব্যবস্থা হল গণতন্ত্র। আসলে কিন্তু গণতন্ত্র বলতে বোঝায়— ওয়াকিবহাল মানুষের সুচিন্তিত অভিমতের ওজন তুলনা করে, যে অভিমতের পাল্লা ভারী সেই দিককে গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি। প্রচলিত ভোটের বন্দোবস্তটা ওই সংস্কৃতিরই আকারপ্রাপ্তি, তার একটি প্রকাশমাত্র। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মূল সুর হল বিভিন্ন মতের মধ্যে অবাধ, অবহিত আলোচনার মাধ্যমে সেতু স্থাপনের প্রয়াস। যে যে ব্যাপারে সেতু গড়া গেল না, সেখানে আপাতত যাঁরা ওজনে ভারী, তাঁরাই কাজ চালাবেন বটে। কিন্তু যে পক্ষের ওজন কম, তাঁদের কথাও মন দিয়ে শুনতে হবে। যাতে ওই বিষয়গুলোর বেলায় সুস্থায়ী সেতু স্থাপন করে, সর্বসম্মত ধ্যানধারণা গড়ে তোলার দিকে এগোনো যায়।

Advertisement

একশো বছর আগে যখন সবুজ পত্র বেরোচ্ছে, তখনও অধিকাংশ লেখার মাধ্যম সাধুভাষা। চলিত বাংলা তখন সংখ্যালঘু রুচিতেই সীমাবদ্ধ। ষাটের দশকের ইস্কুলে আমরা সাধুভাষাতেই পরীক্ষা দিয়েছি। গণতান্ত্রিক আলোচনার আবহ অটুট ছিল বলে, চলিতপন্থী হালকা তরফের কথায় সাধুপন্থী ভারী তরফ কান দিচ্ছিলেন বলে, ক্রমশ চলিত ভাষা জাতে উঠে আসতে পারল। বাংলা লেখার সর্বসম্মত রীতির স্বীকৃতি পেল সে। তখন দেখা গেল, চলিতপন্থীদের যে লড়াই, সেটা তাঁরা সকলের হয়েই লড়ছিলেন। ১৯২০-তে সে কথা পরিষ্কার ছিল না। আজ সকলেই জানি যে, চলিতের জয় বাংলা ভাষার আধুনিকতার অন্যতম জয়।

চলিত বিষয়ক ওই সর্বসম্মতি নির্মাণ করলেই যে কাজ শেষ হয় না, ওই পথে যে আরও অনেক দূর হাঁটলে তবে আধুনিকতার প্রশ্নে স্পষ্টতা আসবে, সেটা অনেকে বুঝতে পারেননি। না বোঝার ফলে অনেক বিভ্রান্তিকর কথা এ দিক-ও দিক ঘুরছে সম্প্রতি। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে দলিত সাহিত্য আকাদেমি প্রতিষ্ঠার পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলায় গণতান্ত্রিক আধুনিকতা নিয়ে দু’-চারটে বিষয় তুলে ধরা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলায় আধুনিকতার আলোচনা সাহিত্যের যে বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছে, সেই বিবেচনার কিছু ঘাটতি চোখে পড়ে; যদি ভিন্প্রদেশের কথাবার্তার দিকে তাকাই।

Advertisement

যেমন ধরুন, কুড়ি বছর পরিশ্রম করে ভারতীয় দলিত ভাবনার দিকপাল অনিকেত জাওয়ারে (১৯৬১-২০১৮) একটি জরুরি বই লেখেন, যা তাঁর অকালমৃত্যুর দু’সপ্তাহ বাদে প্রকাশিত হয়। প্র্যাকটিসিং কাস্ট: অন টাচিং অ্যান্ড নট টাচিং বইয়ে তাঁর মন্তব্য: “দলিতদের রচনাই মহারাষ্ট্রে আধুনিকতার সেরা সূচক (বেস্ট মার্কার)। ...দলিতরা এই প্রথম লিখছেন বলেই দলিতদের রচনা ‘আধুনিক’ এমন ভাবলে ভুল হবে; দলিতরা যে লিখছেন, এই বাস্তবটাই আধুনিকতার উদ্বোধনের সূচক” (১৩৮-৯)। উনি জ্যোতিবা ফুলে আর ভীমরাও অম্বেডকরের স্থান নির্দেশ করেছেন আধুনিকতার উদ্বোধনের প্রথম আর দ্বিতীয় মুহূর্তে। এর জেরেই পরবর্তী যুগের মরাঠি দলিত সাহিত্য এক স্বতন্ত্র সত্তার অন্বেষণে বেরোয়: অনিকেতের মত।

এ রাজ্যে কেউ কেউ বলছেন, বাংলা একটাই ভাষা, তার ঐক্যের জায়গাটাতেই সমস্ত সাহিত্যিক অন্বেষণের চরিতার্থতা। দলিত সাহিত্যের স্বাতন্ত্র্যের চেষ্টার কোনও সাহিত্যিক ভিত্তি থাকতে পারে না। ভাষাতাত্ত্বিক হিসেবে আমার বিনীত নিবেদন, প্রথমত, মহারাষ্ট্রের নজিরের দিকে না তাকিয়েই হয়তো একটু দ্রুত এমন সরলরেখা টানা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ভাষাতত্ত্বের নিরিখেও বক্তব্যটা দাঁড়ায় না। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত আমার দি আদারনেস অব ইংলিশ গ্রন্থে দেখিয়েছি, যাঁরা অভিধান-ব্যাকরণের মতো সংহিতাকেই ভাষার সংজ্ঞা ভেবেছেন, তাঁদের ভাবনা চলমান সংলাপ-স্রোতকে (ডিসকোর্স) অনেক দিন ধরে অগ্রাহ্য করার ফলে গতিশীলতা হারিয়েছে। বাংলা (বা যে কোনও ভাষার) ডিসকোর্সের প্রবহমানতার মধ্যেও নানা বৃত্ত তৈরি হয়, যেখানে বাংলাভাষী কিছু ব্যক্তি অন্য ধরনের পাথেয় অবলম্বন করে নিজেদের মনন তথা রচনার বিকাশের ক্ষেত্র খুঁজে নেন। সে সব প্রয়াসকে নস্যাৎ করে কেউ যদি সেই বৃত্তকে জোর করে ভেঙে দিয়ে ঐক্যের নামে ওই পথিকদের ‘বাংলা’-শিরোনামাঙ্কিত বিরাট একটা মিছিলে এসে জুটতে বাধ্য করেন, তা হলে তাতে ভাষার বা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ তো ঘটে না বটেই, চলিত ভাষা যে বিপ্লবের মাধ্যমে সর্বসম্মতি পেয়েছিল, সেই বিপ্লবের প্রতি দায় অস্বীকার করা হয়।

সেই দায়িত্বের একটা দিক হল বুঝতে শেখা যে, আধুনিকতা একটা ঠিকানা নয়, একটা পথ। ‘চলার বেগে পায়ের নীচে’ যে রাস্তা জেগে ওঠে, সেই পথ। অনিকেত দেখিয়েছেন, আধুনিকতার পথে মরাঠি ভাষা ও সাহিত্যের চলনের তৃতীয় পর্বে দলিতদের স্বতন্ত্র, নিজস্ব রচনার বৃত্ত অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাতেও কি সেই প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে না? সেই বৃত্ত চিহ্নিত করা ও লালন করার প্রয়োজন নেই? বিরুদ্ধ মত অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু দলিত সাহিত্য আকাদেমিতে যে সব কাজ করা সম্ভব, সেগুলো সামনে রেখে সেই সব বিপরীত যুক্তি বলতে হবে।

বাংলা ভাষায় যাঁরা আলোচনা করেন, তাঁরা বড়ই দ্রুত ‘কে কথা বলছেন, কী তাঁর অভিসন্ধি’, এই সব অভিপ্রায়-সম্পর্কিত প্রশ্নে জড়িয়ে যান। এতে আলোচনার ক্ষতি হয়। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধি থেমে যায়। দলিত সাহিত্য আকাদেমি স্থাপন করার পিছনে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কী স্বার্থ আছে, তা নিয়ে আমি মন্তব্য করছি না। যাঁরা আমার বক্তব্য খণ্ডন করতে চাইবেন, তাঁদেরও অনুরোধ করব, বক্তব্যের কথাগুলো ধরে ধরে এগোতে। ‘কে কথা বলছে, কার হয়ে’— এমন অপ্রসঙ্গে জড়িয়ে গেলে যুক্তি-অযুক্তির তফাত চাপা পড়ে যায়। আলোচনার পক্ষ-বিপক্ষের বক্তব্য থেকে পাঠক যেন নিজের মত স্থির করতে পারেন, তিনি যেন অবহিত ভাবনার পথে এগোতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন, এটাই কাম্য।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement