আমার রাগ হয়েছে। ভয়ংকর রাগ। এত কাল যা চেয়ে এসেছি, তার কিস্সু পাইনি। সবাই একগাদা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। কেউ কথা রাখেনি। ঠান্ডা মাথায় কথা বলেছি, কাজ হয়নি। সুর চড়িয়েছি, হুমকি দিয়েছি, তাতেও না। জিনিসপত্র ভেঙেছি, হা হা চেঁচিয়েছি, তাতেও না। তা হলে? এর পর কী!
চোখ চলে যায় আমার সবচেয়ে আদরের, সবচেয়ে মায়াকাড়া জিনিসটার দিকে। আমার আড়াই বছরের মেয়ে। কেমন হবে, যদি ও-ই হয় আমার কাজ উদ্ধারের অস্ত্র? ওর গলায় শেকল বেঁধে, হাতে বন্দুক ধরিয়ে বা প্রতিপক্ষের উদ্যত হাতিয়ারের সামনে ওকে দাঁড় করিয়ে দিই যদি? নরম হবে না উলটো দিকের বদমাশটা, বন্ধ হবে না পালটা আঘাতের চোরা প্রস্তুতি?
ভাবতেই চোখে সরষে, কানে ভোঁ ভোঁ। ছি ছি, সেই লেবার রুমেই না প্রমিস করেছি নিজের জীবন দিয়ে ওকে আঁকড়ে রাখার! কী করে পারলাম এটা ভাবতে যে, ওর বিপদ আমার জয় নিয়ে আসতে পারে? কী করে পারছেন গোর্খাল্যান্ডের সমর্থক মায়েরা একরত্তি সন্তানদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ বানাতে, কখনও মিছিলের সামনে দাঁড় করিয়ে, কখনও হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে?
পেরেছেন, কারণ তাঁরা জানেন, শাসকের ভাবনায় জব্বর নাড়া দিতে হলে শিশুদের ব্যবহার করতে হয়। তাই রাজ্য শিশু অধিকার কমিশন বিমল গুরুঙ্গকে হাজিরা দিতে শমন জারি করা সত্ত্বেও ফের মিছিলে দেখা গেল আধফোটা কচি মুখগুলোকে। ওই ক’টা মুখের যে শক্তি, পাহাড়ের সব অস্ত্র একসঙ্গে রাখলেও তার ধারেকাছে আসে না। জোয়ান পিঠে টিউবলাইটের আঘাত দেশ-বিদেশে যতটা তোলপাড় ফেলবে, তার চেয়ে অনেক বেশি ফেলবে ওই শীতে খালি গায়ে শেকল পরা ছোট্ট চেহারাগুলো। তক্ষুনি তুলে ধরা যাবে রাষ্ট্রের ‘অত্যাচারী’ চেহারাটা। সহজ হিসেব। এই ভাবনা শুধু দার্জিলিঙের নিজস্ব নয়। কাশ্মীর সমস্যা থেকে শুরু করে স্কুলের অনিয়ম— অনেক প্রতিবাদের, আন্দোলনের এটাই ইউএসপি। যে দাবি প্রতিপক্ষের চোখে অন্যায্য, অবৈধ অথবা ঠান্ডা ঘরে সেঁধিয়ে যাওয়াই যার ভবিতব্য— তা আদায় করতে শিশুরাই সবচেয়ে সহজ ঘুঁটি। ওরাই একমাত্র গলিয়ে দিতে পারে দাবি-না-মানার ইস্পাত মন। শৈশব তাই ব্ল্যাকমেলিং-এর মোক্ষম অস্ত্রও বটে। রইল পড়ে শিশুর অধিকার। তা সে সব তো বই সাজানোর জন্য লেখা হয়েছে। সেখানেই থাক বরং।
দার্জিলিঙে শিশুদের এমন ‘অপব্যবহার’ দেখে অবশ্য ভারী হইচই পড়েছে। পাহাড়কে বঞ্চনা নিয়ে যাঁরা মুখ খুলছিলেন, তাঁরাও জিভ কেটেছেন। কিন্তু দাবি পূরণে শিশুদের ঢাল করার মানসিকতা তো শুধু রাজনীতিতে নেই। ওটা খুঁজে পাওয়া যাবে আমাদের সমাজে। স্পষ্ট ভাষায়, নিজেদের সংসারেই। আমার পরিচিত এক দম্পতি তাঁদের শিশুটিকে চমৎকার ব্যবহার করতেন অন্য শহরে থাকা বাবা-মায়ের কাছ থেকে জিনিস আদায় করতে। প্রায় প্রতি মাসেই আদরের নাতনির কাছ থেকে একখানি চিঠি আসত দাদু-দিদার কাছে, নানা জিনিসের ফরমায়েশ নিয়ে। এমন আরও আছে।
আসলে, ঠেকায় পড়লে আমরা অনেকেই নিজের সন্তানকে ঢাল বানাই। খেতে যাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, পছন্দের চ্যানেল দেখা, অন্য পক্ষের মান ভাঙানো— প্রতি দিনের দরকারি, অদরকারি হরেক ইচ্ছেয়, দাবিতে নিজের সন্তানকেই তো ব্যবহার করি আমরা। সে ইচ্ছের গুরুত্ব ওরা বুঝুক, না বুঝুক! মুশকিল হল, সংসারের চৌহদ্দিতে তো শিশুর অধিকারের মূল প্রশ্নগুলো এখনও রে রে করে ঢুকে পড়েনি। তাই স্বামী-স্ত্রী’র ঝগড়ায়, শাশুড়ি-বউয়ের দড়ি টানাটানিতে বাড়ির একরত্তিটাকে টেনে আনা হলেও ‘গেল গেল’ রব ওঠে না। ভাবখানা এমন, শিশুদের তো মগজ বলে কিছুই নেই। পরিষ্কার সাদা পাতা যেন একখানা। সেখানেই ইচ্ছেমত মন্ত্র ভরে দেওয়া হোক। অমনি ওরাও উগরোতে শুরু করবে সেটা। ওদের কল্পনা, পুতুলের বাক্স, কুমির-ডাঙা— ছিটকে যায় তো যাক।
তবে ওদের বাঁচানোর উপায় কী? সমস্ত বাস্তবতা থেকে ওদের সরিয়ে রাখাই কি শৈশব বাঁচানোর একমাত্র রাস্তা? আসলে তা নয়। যে পরিস্থিতিতে শিশু বড় হচ্ছে, তার প্রভাব শিশুর ওপর পড়বেই। যে পরিবারে নিত্য অশান্তি, সেখানে সন্তানটির গায়েও আঁচ লাগবে। ঠিক যেমন গোর্খাল্যান্ডের দাবি নিয়ে অশান্ত পাহাড়ের শিশুরা আশৈশব বিক্ষোভ, বন্ধ দেখেই অভ্যস্ত। কেন বিক্ষোভ— সে নিয়ে ধারণা ভাসা ভাসা, অস্পষ্ট হলেও সেটা তাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে জড়িয়ে। কিন্তু সেটা জানে সে তার শিশু মন নিয়েই। বন্ধের পাহাড়ে সে যেমন মায়ের সঙ্গে খাবারের খোঁজে বেরোয়, তেমন আবার সঙ্গী জুটিয়ে খেলতেও বসে। ওই রামধনু দুনিয়া থেকে তাদের হেঁচকে বের করে আনা অন্যায়। শিশুরা প্ল্যাকার্ড নয়, যে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তাদের যখন খুশি দুনিয়ার সামনে তুলে ধরা যাবে, নিজেদের স্বপ্নকে তাদের শরীরে এঁকে দেওয়া যাবে। সেটা পাহাড়েও সত্যি, সংসারেও তা-ই।
দার্জিলিঙে শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু যাঁরা তা নিয়ে ভারী উতলা হয়ে পড়েছেন, তাঁরা নিজের ঘরটা দেখে নিয়েছেন তো?