মিড ডে মিল।
সরকার-পোষিত বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের ‘মধ্যাহ্নকালীন আহার’ (মিড-ডে মিল) নিয়ে নানা রকম বিতর্ক দেখা দিয়েছে সম্প্রতিকালে। সেদিন ট্রেনে যেতে যেতে পাশের যাত্রীদের আলোচনা শুনছিলাম। এ রাজ্যের একটি বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নুন-ভাত দেওয়ার ঘটনাটি সামনে আসায় এই সব আলোচনা খুব বেড়েছে চারিদিকে। তবে সমীক্ষা করলে দেখা যাবে, ‘মিড ডে মিল’ ব্যবস্থা প্রচলনের ফলে প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয় আসার প্রবণতা বেড়েছে যথেষ্ট। দরিদ্র ছাত্রছাত্রীরা বিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনার সঙ্গে পেটপুরে খেতে পাচ্ছে, এটা গরিব অঞ্চলের মানুষের কাছে খুব আনন্দের। সঙ্গে রয়েছে পুষ্টির গুরুত্ব। যারা দিন আনে দিন খায়, অনাহারে দিন কাটায়, তাদের এক বেলা পেট ভরে খেতে পেলে পুষ্টিমাত্রা রক্ষা পায়। এর ফলে বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের হাজিরাও বেড়েছে অনেকাংশে। আর সে কারণেই বলা যায় শিক্ষার প্রসারে, স্বাস্থ্য গঠনে ‘মিড-ডে মিল’ ব্যবস্থার ভূমিকা খুব কম নয়।
যদিও এতে বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনের সময় কিছুটা কমেছে। কিছু শিক্ষকের কাজও বেড়েছে, রান্নার মালপত্র কিনে দেওয়া, রান্না ও খাওয়ানোর তদারকি করা, হিসাব রাখা এবং ঠিক সময়ে তা ব্লক অফিসে জমা করার মতো নানা কাজে বিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষককে ব্যস্ত থাকতে হয়। টিফিনের আগে থেকেই ছোটো ছোটো ছাত্রছাত্রীরা থালা বাজাতে শুরু করে, টিফিন শেষ হলেও খাওয়া শেষ হয় না, খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার করা ইত্যাদি নানা সমস্যা নানা ভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে দেখা দিচ্ছে। তবু এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, ভালোয় মন্দোয় মিলে ‘মিড-ডে মিল’ ব্যবস্থা দেশের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় এক বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। এবার একটু দৃষ্টি ফেরানো যাক এই ‘মিড-ডে মিল’ ব্যবস্থার ইতিহাসে।
১৯৯৫ সালের ১৫ই আগস্ট ‘ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অব নিউট্রিশনাল সাপোর্ট’ (এনপি-এনএসপিই) দেশের বিদ্যালয়ে সার্বিকভাবে মধ্যাহ্নকালীন আহার (মিড-ডে মিল) ব্যবস্থার প্রচলন করে। কিন্তু এর বহু আগে ১৯২৫ সালে ভারতবর্ষে প্রথম এই মধ্যাহ্নকালীন আহার ব্যবস্থা শুরু হয় মাদ্রাজে। তৎকালীন মাদ্রাজ করপোর্সন প্রথম এ দেশে এ ব্যবস্থার পত্তন করে। এর পরে ১৯৩০ সালে ফরাসিরাও পুদুচেরিতে বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নকালীন আহারের ব্যবস্থা শুরু করে। তবে স্বাধীন ভারতে প্রথম এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী কে. কামরাজ। তিনিই প্রথম স্বাধীন ভারতে মধ্যাহ্নকালীন আহার ব্যবস্থার বিষয়ে গঠনমূলক ভাবনার সূত্রপাত করেন। তাই তামিলনাড়ুকেই বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নকালীন আহার ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক বলা যায়। ১৯৮২ সালে এই বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করেন তামিলনাড়ুর আর এক মুখ্যমন্ত্রী। তিনি হলেন এম. জি. রামচন্দ্রন। তিনি নিউট্রিসাস ফুড প্রকল্পে রাজ্যের প্রায় ৬৮ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর জন্য বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নকালীন আহারের (মিড-ডে মিলের) ব্যবস্থা করেন। এরপর ১৯৮৪ সালে গুজরাটে এ ব্যবস্থা শুরু হয়। কিন্তু গুজরাটে এ ব্যবস্থা বেশি দিন চলেনি সে-সময়। ১৯৮৪ সালেই কেরালাতেও শুরু হয় এই ‘মিড- ডে মিল’ ব্যবস্থা। পরে ১৯৯০-৯১ সালে আমাদের দেশে বারোটি রাজ্যে বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নকালীন আহার (মিড-ডে মিল) ব্যবস্থা শুরু করা হয়। তারপর ১৯৯৫ সাল থেকে প্রাথমিক এবং ২০০৭ সাল থেকে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মিড-ডে মিল প্রদানের ব্যবস্থা করা হয় অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে। ঠিক হয় প্রাথমিক অর্থাৎ প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৪৫০ ক্যালোরি (প্রোটিন-১২ গ্রাম) ও উচ্চ প্রাথমিক ছাত্রছাত্রীদের জন্য ৭০০ ক্যালোরি (প্রোটিন-২০ গ্রাম) শক্তিযুক্ত খাদ্য দেবার কথা। বর্তমানে প্রায় ১২ কোটির বেশি ছাত্রছাত্রী এই সুবিধার অন্তর্ভুক্ত। যদিও ২০০৯ সালেও ভারত গ্লোবাল হাঙ্গার সূচকে ৮৪-এর মধ্যে ৬৫ স্থানে ছিল, যেটি খুব সম্মানের বা আশার কথা নয়।
এবার আসা যাক ‘মিড-ডে মিল’ ব্যবস্থার বাস্তব কিছু দিক নিয়ে কিছু কথা। বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী পিছু মধ্যাহ্নকালীন আহারের ( মিড-ডে মিল) জন্য বরাদ্দ প্রাথমিকে ১০০ গ্রাম চাল ও উচ্চ প্রাথমিকে ১৫০ গ্রাম। আর এ ক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ প্রাথমিক শ্রেণির জন্য ছাত্র পিছু চার টাকা আটচল্লিশ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকের জন্য ছয় টাকা একাত্তর পয়সা। এই চাল এবং অর্থ দিয়ে ছাত্র বা ছাত্রীদের মধ্যাহ্নকালীন আহারের ব্যবস্থা করা কি বর্তমান দ্রব্যমূল্যে সম্ভব? যেখানে খুব সস্তার হোটেলগুলিতেও বর্তমানে জনপ্রতি চল্লিশ টাকার উপর নিরামিষ আহারের দাম, সেখানে এই সামান্য পরিমাণ অর্থ দিয়ে কিভাবে সুন্দর এবং উৎকৃষ্ট খাবার খাওয়ানো যাবে ছাত্রছাত্রীদের! তাহলে প্রশ্ন কী করে বিদ্যালয়গুলিতে মধ্যাহ্নকালীন আহার খাওয়ানো হয়?
মিড ডে মিল
এখানেই রয়েছে মূল সমস্যা। শহরের অভিজাত বিদ্যালয়গুলিতে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরাই বাড়ি থেকে জলখাবার নিয়ে আসে। খুব কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রী এ সব বিদ্যালয় থেকে দেওয়া মধ্যাহ্নকালীন আহার খায়, কিন্তু বরাদ্দ অর্থ আসে নথিভূক্ত ছাত্রছাত্রী অনুযায়ী। তার ফলে বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীর জন্য আসা অর্থ দিয়ে কম সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে সুন্দর খাওয়ানো যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্থ উদবৃত্তও হয়। আর সমস্যা তৈরি হয় প্রত্যন্ত গ্রামের কম ছাত্রছাত্রী থাকা বিদ্যালয়গুলিতে। সেখানে যতগুলি ছাত্রছাত্রী নথিভুক্ত, ততগুলি ছাত্রছাত্রীই ‘মিড-ডে মিল’ খায়। তার ফলে ওই অল্প অর্থে ছাত্রছাত্রীদের ঠিকভাবে খাওয়ানো কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে খাওয়ানোর মান নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয় জনমানসে।
এক বিদ্যালয় যেখানে ডিম বা মাংস খাওয়ায় ছাত্রছাত্রীদের, অন্য বিদ্যালয়ের তখন সামান্য ডাল, ভাত, তরকারি জোটানোই কঠিন হয়ে পড়ে। ‘মিড-ডে মিলে’র রান্না যাঁরা করেন তাঁদের বেতনও খুব সামান্য। সাধারণত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারাই বিদ্যালয়ে ‘মিড-ডে মিলে’র রান্নায় নিযুক্ত আছেন এ রাজ্যে, এঁদের পারিশ্রমিক মাসে মাত্র দেড় হাজার টাকা, আর কিছু খাবার পান এঁরা।
তবে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীদের পুষ্টির জন্য এই মিড ডে মিল প্রথার জুরি নেই। এতে করে দিনে অন্তত একবার শিশুরা পেট ভরে খেতে পারে। আমাদের দেশে প্রতিদিন বহু শিশু অপুষ্টির শিকার হয়। সেখানে এই ব্যবস্থা শিশুদের স্বাস্থ্যরক্ষায় উপযোগী। আমার মনে হয়, ‘মধ্যাহ্নকালীন আহার’ ব্যবস্থার পরিকাঠামোটিকে আরও যুক্তিসম্মতভাবে নির্মাণ করা প্রয়োজন, তবেই এই ব্যবস্থাটি আরও সুচারুভাবে সম্পন্ন করা যাবে, বাস্তবায়িত হবে এর মূল লক্ষ্য। বিতর্কও কিছুটা দূর হবে।
লেখক সাহিত্য ও নাট্যকর্মী,
মতামত নিজস্ব