অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
অকালে চলে গিয়ে অঞ্জন কালের মন্দিরা হয়ে গেল। মহাকাল সত্যিই তাঁর রথের ঘোড়া খুঁজে নেন। একেক যুগে একেকভাবে। পুরাণকালে তাঁরা হতেন যুগপুরুষ, এখন তাঁদের বলে আইকন। অঞ্জনের অকাল-সন্ধ্যা তাকে কালপ্রতিমা করে তুলল।
অঞ্জন মানে অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার ভাই। কিন্তু এ লেখা সেই ভাইকে নিয়ে নয়। লেখা তার মৃত্যুর বিমূর্ততা নিয়ে। কেন কোনও কোনও মৃত্যু সহসা সমাজের চিত্তে নিদারুণ আঘাত হানে, যেমনটা অঞ্জনের জন্য চারপাশের অবারিত শোকোচ্ছ্বাসে দেখছি? কেন কোনও কোনও মৃত্যু এমন করে কাঁদায়, অজানিত অপরিচিতকেও? কেন কোনও কোনও মৃত্যুশোকে সমাজের স্বাক্ষর দেখি?
অনুমান করি, এর প্রথম কারণ নিহিত আছে ওই অকালত্বে, ওই অ-কালের আকস্মিকতায়। যে মৃত্যু অপ্রত্যাশিত, অচিন্ত্যপূর্ব, অনবধারিত, সে মৃত্যু বেশি বিমূঢ় করে। যিনি যাচ্ছেন, তিনি যখন প্রতিভাবান হন, তখন সমাজ আরও বিচলিত হয়। সমাজের সঙ্গে প্রতিভার এক ধরনের চুক্তি থাকে, পরস্পরকে আরও বহু কাল সমৃদ্ধ করার চুক্তি। প্রতিভাবানের অকাল-নিষ্ক্রমণে মুহূর্তে অপরিকল্পিতভাবে চুক্তিতে ছেদ পড়ে, আবেগের অভিঘাত ওঠে। সমাজ বঞ্চিত বোধ করে।
দ্বিতীয় কারণ বুঝি নিহিত আছে প্রতিভার বিশেষ ক্ষেত্রটিতে। বিদায়ী নায়ক কোন মঞ্চে, কোন নাট্যে অভিনয় করতে করতে সহসা প্রস্থান করলেন, সেটা সামাজিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একেকটা যুগ, একেকটা সমাজ, একেক ভাবে, একেক ধরনের মঞ্চ বা নাট্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে, একেক ধরনের পারফর্মার নিয়ে বেশি উদ্বেলিত বোধ করেছে। একদা ধর্মনায়করা যুগনায়ক হতেন, পরে বাংলায় কবিরা সেই স্থান পান। রবীন্দ্রনাথের সময় থেকেই ভঙ্গ ও রঙ্গে ভরা বঙ্গভূমি কবিতাতে খুঁজে পেয়েছে তার সান্ত্বনা ও সমর্থন। বড় কবির মৃত্যুতে দু’কূলপ্লাবী বিহ্বলতা দেখেছি। চলচ্চিত্রের নায়ক বা পরোপকারী রাজনীতিবিদ-ও মৃত্যুতে নগরজোড়া অনুরণন সৃষ্টি করেছেন। সাংবাদিকদের যাওয়াতেও বহু মহল বিচলিত হয়েছে, কিন্তু তাঁরা তো সব ছিলেন ত্রিকালদর্শী বিজ্ঞ ভাষ্যকার-সমাজ তাঁদের অধিনায়ক হিসেবে দেখেছে। আজ এই তরুণ, চঞ্চল, ক্ষিপ্রগতি, সহাস্য সাংবাদিকের বিদায়ে শোকাভিভূত হয়ে সমাজ কি কোনও অন্য বার্তা দিচ্ছে? সন্দেহ করি, অডিও-ভিস্যুয়াল মাধ্যমে (এবং তার আগেই ডিজিটাল মাধ্যমে এবং তারও আগে প্রিন্টের পৃষ্ঠায়: অঞ্জনও তো ভিন্ন অর্থে ত্রিকালদর্শী ছিল!) অহোরাত্র বর্ণময় সংযোগে দর্শক তাঁর প্রক্ষেপক-নায়কের সঙ্গে যে নিগূঢ় সম্বন্ধ নির্মাণ করেন, অঞ্জনের মৃত্যু সেই সম্বন্ধ-নির্মিতির নূতন বাস্তবের দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। ক্রমেই নিউক্লিয়ার হতে থাকা, ক্রমেই নিও-লিবারাল মাইক্রো-উদ্যোগী হতে থাকা, ক্রমেই বিপন্ন, বিচ্ছিন্ন ও একক হতে থাকা একেক জন দর্শককে ছুঁয়ে সংবাদের ডিজিটাল বা অডিও-ভিস্যুয়াল নায়কই তো গড়ে তোলেন এক নতুন ভার্চুয়াল সমাজ, এক নতুন ঘরানার পাবলিক স্পেস। অঞ্জনের চলে যাওয়ায় ধাক্কা খেয়ে সমাজ তার ভার্চুয়াল সত্তাকেই অন্তরে অনুভব করল। আমাদের জনসমাজ এখন যতটা ভৌত, তার চেয়ে বেশি বৈদ্যুতিন, যতটা ফিজিক্যাল, তার চেয়ে বেশি ভার্চুয়াল— যাওয়ার সময় অঞ্জন কালের এই বার্তাকে স্পষ্ট করে গেল। অডিও-ভিস্যুয়াল জার্নালিজমের বা ডিজিটাল সাংবাদিকতার আর কোনও প্রধান ব্যক্তিত্ব এর আগে হঠাৎ এই ভাবে চলে যাননি, বার্তাটি তাই অনুভূত হয়নি। অঞ্জন বুঝিয়ে গেল, সমাজ অন্য গড়ন পেয়েছে। সমাজ আকুল হয়ে জানাল, সে কথা সে বুঝতে পেরেছে। একদা পল্লিসমাজে শোকে যে কলরব হত, আবার সেই কলরব ফিরে এল অন্দরে-কন্দরে।
তৃতীয় কারণটি বোধহয় পন্থা ঘটিত। কিবা ভৌত বাস্তবে, কিবা বৈদ্যুতিন বাস্তবে, সমাজ দ্বন্দ্বমুখরতা চায়। সেই কবে বুদ্ধ ও সক্রেটিসের সময় থেকেই তো ডায়ালেকটিকসের রমরমা, তর্কে প্রতীতি। অঞ্জন তর্ক সঞ্চালনে সিদ্ধহস্ত ছিল। নেতি নেতি করে যে সত্যের সন্ধান, বহু পন্থার মধ্য দিয়ে মধ্যবর্তী পন্থা সত্যের খোঁজ, নিত্য সন্ধ্যায় সেটাই ছিল অঞ্জনের আরতি। ভৌত বাস্তবের উঠানে, রাজনৈতিক সমাজের প্রত্যক্ষ পরিসরে যতই একতরফা জোরাজুরি বেড়েছে, ভার্চুয়াল সমাজের পরাবাস্তবে মানুষ তত তর্কমুখর পথসন্ধান গরমাগরম উপভোগ করেছে। টেলিভিশনের সান্ধ্য বাসর যদি হয় পুরাতন পল্লিসমাজের দর্পণ, তবে একই সঙ্গে সে বাসর তো নানা বিকল্পের প্রাচীন তর্পণও বটে। অঞ্জন ভার্চুয়াল জনসমাজের তর্কপন্থী সত্যসন্ধানের কারিগর হয়ে উঠেছিল, বহু দর্শক সে কারণেও সহসা বিচল। বাজারে নিওলিবারালের নিশ্চিত প্রতীতি নয়, নিয়ন্ত্রণে বামমার্গীয় ধ্রুব বিশ্বাস নয়— মধ্যপথগামী সত্য সন্ধানেই অঞ্জনের আগ্রহ ছিল। দ্বিধাদীর্ণ বাম-ঘেঁষা বাঙালির কাছে এই আগ্রহ আকর্ষক ছিল।
চতুর্থ কারণটি পন্থার বিস্তার সংক্রান্ত। অঞ্জন পছন্দ করেছিল পর্দার সান্ধ্য বাসরকে উন্মুক্ত করতে। জনতার মুখরিত সখ্যে নিয়ে যেতে। জনতার দরবারে আপনার রায় আপনি দিন— এই রকম এক অন্তরঙ্গ আলাপচারির ভঙ্গিতে অঞ্জন নেমে যেত মাঠে-ময়দানে, তারকাখচিত আকাশের তলায়। এইটা বোধহয় দর্শকের পছন্দ হত। এই প্রসার, ভার্চুয়াল জনসমাজের এই সম্প্রসারণ, এই স্পর্শতৃষ্ণাকাতর বিস্তার সত্যিই শৈলীতে অনন্য ও কনটেন্টে গভীর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, দর্শক বোধহয় কৌম অবচেতনে বুঝতেন, বাংলার ভৌত ভদ্রসমাজ একদা এই ভাবেই নিজেদের সম্প্রসারণ করতে করতে গ্রাম-মফস্সলে বিস্তৃত হয়েছিলেন। ভার্চুয়াল জনসমাজের সম্প্রসারিত বিস্তার-প্রয়াস একই সঙ্গে একটি hegemonic এবং democratic প্রকল্প হয়ে ওঠে, যেমনটি একদা ভৌত সমাজের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। অঞ্জন এই ভাবেই কালের মন্দিরা হয়ে ওঠে।
পঞ্চম কারণটি, সন্দেহ করি, ওই গ্রাম-মফস্সলের মধ্যে রয়েছে। অঞ্জন গ্রাম-মফস্সলের মানুষ। তার একটা নদী ছিল, সেই নদীর নাম টুমুনি। তার একটা গ্রাম ছিল, সেই গ্রামের নাম বালিজুড়ি। সেই গ্রামে তার একটা পারিবারিক কালীপুজো ছিল, সেই কালীর নাম মুক্তকেশী। সে বড় হয়েছিল মান্দারবনি নামের এক অলৌকিক কোলিয়ারিতে, ভাঙা পথের রাঙা ধুলায়। এই সব গভীর পরিপ্রেক্ষিত তাকে পরবর্তী কালের নরেন্দ্রপুর-প্রেসিডেন্সি জীবনে রসদ জুগিয়েছে, তার তূণীরে অস্ত্র হিসেবে কাজ করেছে। অকাতর মানুষের মধ্যে নেমে যাওয়ায়, চ্যানেলের বুমটিকে রাজদণ্ডরূপে নিজের হাতে তুলে নিয়ে মানুষের মধ্যে ছুটে যাওয়ায় দর্শক সেই গ্রাম্য মফস্সলী তৃষ্ণার্ত মানুষটিকে লক্ষ করেছে। মফস্সলের নগরবিজয়ই বাংলার নাগরিক ইতিহাসের সারাংশ। নাগরিকের মফস্সলে প্রত্যাবর্তন ও সেখানে জনসমাজের আলোচনামুখর বিস্তার বাংলার সামাজিক ইতিহাসের মর্মবস্তু। উদ্যতদণ্ড অঞ্জনের তর্ক-উদ্ভাসিত সারথ্যে বঙ্গসমাজ নিজেদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে ভার্চুয়ালি অনুভব করেছে।
ষষ্ঠত, নায়কের এই মফস্সলে প্রত্যাবর্তন ট্র্যাজিক হয়েছে। কোভিডের মর্মান্তিক সময়ে, ভোটের নিদারুণ বাজারে, টিকা-হীন, কবচকুণ্ডলহীন, একাকী সেনাপতির সীমান্ত-অভিযান তাকে রোগশয্যায় ঠেলেছে এবং জীবনের রঙ্গমঞ্চে থাকতে দেয়নি। এই ট্র্যাজেডির ছবিটি বাঙালির চেনা trope, পরিচিত ক্যানভাস। এই বিয়োগব্যথা ও স্মৃতিকাতরতা তার ডিএনএর অঙ্গ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সেই সময়’-এ একদা সেই সব নবীন নায়কদের কথা লিখেছিলেন, যাঁরা এক-একটা নতুন পথের দিশা দিতে না দিতে চলে গিয়েছিলেন। অনুভব করি, বৈদ্যুতিন জনসমাজের সম্প্রসারণকামী ও সম্প্রসারণপ্রেমী উদ্যোগের ভার্চুয়াল পথনায়ক হিসেবে অকালপ্রয়াত অঞ্জনের মধ্যে আমরা সেই রকম এক নতুন দণ্ডধারী পথিকৃৎকে পেয়েছিলাম বলেই আজ চারিদিকে এত শোকোচ্ছ্বাস।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি অঞ্জনকে এক যুগনায়ক হিসেবে স্মরণ করব। কালের মন্দিরা মানে কালের বাদ্যযন্ত্র। অঞ্জন কালের বাজনা হিসাবে বেজেছিল। রবীন্দ্রনাথের গানে ও শরদিন্দুর উপন্যাসে কীর্তিত মন্দিরার অপর নাম জুড়ি। এটি কাঁসার তৈরি দু’টি বাটি। মন্দিরার মাঝখানে ছিদ্র করে মোটা সুতোয় বেঁধে দু’হাতে ধরে পরস্পরের মুখে টোকা দিয়ে তাকে বাজানো হয়। সুতো ছিঁড়ে একটি বাটি ছিন্নজীবন হলে অন্য বাটি আর বাজে না।
(এবিপি ডিজিটালের প্রাক্তন সম্পাদক এবং প্রিন্ট-ইলেক্ট্রনিক-ডিজিটালে সমান সিদ্ধহস্ত অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কোভিডে অকালপ্রয়াণে তাঁর দাদা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ)