পাকিস্তানে যেন মুখোশের জয় না হয়, জয় হোক গণতন্ত্রের। ছবি: এএফপি।
অদ্ভুত এক অবস্থান আমাদের। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আমরা। কিন্তু আমাদের চারপাশের দেশগুলোয় সুস্থির গণতন্ত্র বা পুরোদস্তুর গণতন্ত্র খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। উত্তরে দোর্দণ্ড প্রতাপ কমিউনিস্ট নামধারী শাসন। পূর্ব সীমান্তের বাইরে তাকালে প্রায় প্রশান্ত মহাসাগরের কিনারা পর্যন্ত গিয়েও হাতে গোনা সুস্থির গণতন্ত্রের সন্ধান মেলে। আর পশ্চিম সীমান্তের ও পার থেকে একেবারে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত অস্থির হয়ে রয়েছে পরিস্থিতি। তারই মধ্যে নির্বাচন হল পাকিস্তানে। গণতন্ত্র সুস্থিতি পাবে কি পশ্চিমের প্রতিবেশী ভূখণ্ডটায়? সাগ্রহে সে দিকেই তাকিয়ে ভারত।
একই সঙ্গে স্বাধীনতা পেয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আর পাকিস্তান গণতন্ত্রের সড়কে পরিণত ভঙ্গিতে হাঁটতেই শেখেনি এখনও পর্যন্ত। বার বার টালমাটাল হয়েছে নির্বাচিত সরকার, বার বার আক্রান্ত হয়েছে গণতন্ত্র, বার বার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।
১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু ২০১৩ সালে প্রথম বার একটি নির্বাচিত সরকার অন্য একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির হাত থেকে ক্ষমতার রাশ যায় পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ)-এর হাতে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির সে সরকারকে খুব সুস্থির ভাবে চলতে দেওয়া হয়েছিল, তেমন কিন্তু নয়। একাধিক বার প্রধানমন্ত্রী বদল করতে হয়েছিল শাসক দলের তৎকালীন নেতা আসিফ আলি জারদারিকে। পরে ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকার কথা ছিল, সেই নওয়াজ শরিফকেও পুরো মেয়াদ টিকতে দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি, নিজের দলেরই অন্য নেতাকে সে পদে বসান নওয়াজ। তবে সে প্রধানমন্ত্রী আদৌ কতটা নওয়াজের নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করেছেন, তা নিয়েও বিস্তর সংশয়।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আবার একটা নির্বাচনের মুখোমুখি হল পাকিস্তান। ভোট মিটল। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছে আরও এক বার একটি নির্বাচিত সরকারের হাত থেকে আর একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা যেতে চলেছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টির এই উপলব্ধি কতটা খাঁটি, তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ অনেকটাই। সংশয় শুধু পাকিস্তানের বাইরে নয়, সংশয় প্রবল পাকিস্তানের অন্দরেও।
আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি প্রায় হাতের মুঠোয় ইমরানের
সরাসরি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নয়, এ বার নির্বাচন দেখিয়ে ক্ষমতা হস্তগত করতে চাইছে সামরিক বাহিনী— এমন একটা গুঞ্জন গোটা পাকিস্তানে শোনা যাচ্ছে। গণতন্ত্রের হয়ে দশকের পর দশক লড়তে থাকা যে সব রাজনীতিকের সঙ্গে সেনার সঙ্ঘাত রয়েছে, তাঁদের দল জিততে পারবে না, রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত নবীন কেউ জিতবেন, কারণ তিনি প্রকাশ্যে সেনার পাশে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেছেন এবং সবচেয়ে উচ্চস্বরে ভারত বিরোধী জিগির তুলেছেন— এমন সব জল্পনা ভোটের অনেক আগে থেকেই চলছিল পাকিস্তানে। বিপদটা সেখানেই। আপাতদৃষ্টিতে একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সংঘটিত হল। কিন্তু নাগরিকের ভরসা নেই তাতে। আদৌ কি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এ? নাকি সবই লোক দেখানো? ভোটের ফলাফল জনমতের প্রতিফলন তো? নাকি নেপথ্য থেকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করল সবটা? নাগরিকের মনে বার বার এই সব প্রশ্ন জাগছে। এই বাতাবরণটা একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয়। গণতন্ত্রের পক্ষে তো নয়ই, রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষেও নয়।
পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কোনও নেপথ্যচারীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন কি না, তা স্পষ্ট হয়ে যাবে অচিরেই, খুব বেশি দিন সময় লাগবে না। তবে নির্বাচন যখন একটা হলই, গণতান্ত্রিক একটা প্রক্রিয়া যখন অনুসৃত হলই, তখন গণতন্ত্রের জন্য শুভকামনাই থাক।
পাকিস্তানে যেন মুখোশের জয় না হয়, জয় হোক গণতন্ত্রের। সুস্থির মন্ত্রিসভা গঠিত হোক, নাগরিক জীবন সমৃদ্ধ হোক, ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াক, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ হোক, প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্কের লক্ষ্যে পাকিস্তান পদক্ষেপ করুক। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক বাহিনী নিজের নিজের বৈধ পরিসরে থেকে কাজ করুক। নতুন মন্ত্রিসভার হাত ধরে নতুন দিনের শুরু হোক পাকিস্তানে। ভারতবাসীর তরফ থেকে আপাতত এই শুভেচ্ছা থাক পাকিস্তানের জন্য। তবে নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে পাকিস্তানি জনমানসে সংশয় যদি কিছু তৈরি হয়ে থাকে, গণতন্ত্রের বদলে মুখোশের জয় সূচিত হওয়ার কোনও আফসোস যদি চারিয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে সে সন্দেহের নিরসনের দায়টাও নতুন সরকারের ঘাড়েই চাপতে চলেছে। সে কাজ কিন্তু খুব সহজ হবে না।