সম্মিলিত জনতা যখন একটি মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করে সমবেত ভাবে তাঁকে প্রহার করে তাকেই বলা হয় গণপিটুনি। অর্থাৎ গণপিটুনির নেপথ্যে কাজ করে জনতার রায়, জনাদেশ। আমরা অনেকেই মনে করি, সম্মিলিত মানুষের সমষ্টি কোনও অন্যায় কাজ করতেই পারে না। সমাজ গঠিত হয়েছিল মানুষের প্রয়োজনে, মানুষের চাহিদায়। কিন্তু এই সমাজের হাত যত শক্ত হয়েছে, ব্যক্তি মানুষ ততই দুর্বল হয়েছে। খর্ব হয়েছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যও। সমাজের যৌথশক্তি এক দিকে যেমন দুর্বল অক্ষম মানুষকে রক্ষা করে আবার অন্য দিকে সমাজের চোখে অপরাধী, ক্ষতিকারক মানুষকে করে প্রবল পীড়ন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণপিটুনির শিকার হন দুর্বল, অসহায় মানুষ। তাঁদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীন, নারী, শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী, ভিখিরি রয়েছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অতি তুচ্ছ কারণে গণপিটুনির ঘটনাগুলি ঘটে। চোর সন্দেহে, ডাইনি সন্দেহে, ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায়। এই খবরগুলি এতটাই গা-সওয়া
হয়ে গিয়েছে যে, এই মৃত্যুগুলো আমাদের আর আলাদা ভাবে ভাবায় না। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই নিহত মানুষগুলির মধ্যে খুব কম সংখ্যক মানুষ অপরাধ কর্মের সঙ্গে জড়িত, বেশিরভাগই হয়তো নিরাপরাধ।
গণপিটুনির নেপথ্যে প্রধান যে বিষয়গুলি কাজ করে তা হল গুজব ও কুসংস্কার। গুজব ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করে ও সেই আতঙ্ক থেকেই গণপিটুনির ঘটনাগুলি ঘটে। ছেলেধরা গুজবে বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় কোনও ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই মানুষের মনে সন্দেহের বীজাণুরা বাসা বাঁধে। সেই মানুষটির কথাবার্তা অসংলগ্ন বলে মনে হলে জনগণ ধরেই নেয় মানুষটি সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক ও তার সমুচিত শাস্তি পাওয়া উচিত। তাই সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে জনগণ নিজের হাতে আইন তুলে নেয় ও পিটিয়ে হত্যা করে মানুষটিকে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানুষটি মানসিক ভারসাম্যহীন অথবা শিক্ষিত মানুষের কূট প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। ভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষের ক্ষেত্রেও গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। বর্তমানে যুক্ত হয়েছে ধর্ম রক্ষার জন্য গণপিটুনি। ভারতে গত চার পাঁচ বছরে গণপিটুনির যে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই ঘটেছে গোরক্ষাকে কেন্দ্র করে। কোথাও গোমাংস ভক্ষণকে কেন্দ্র করে ধর্মরক্ষকেরা গণপিটুনিতে বিধর্মীকে হত্যা করে হাতের রক্ত মুছেছে সমাজের গায়ে, আবার কোথাও গরু পাচারকে কেন্দ্র করে পাচারকারীকে পিটিয়ে মেরে নিজেদের নৈতিক দায়িত্ব পালন করেছে ধর্মের ধ্বজাধারীরা।
এগুলোর মধ্যে কোনও ক্ষেত্রেই সম্মিলিত হত্যাকারীরা কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়নি। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে গিয়ে পিটিয়ে খুনের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্মিলিত ভাবে হত্যাকাণ্ড অনায়াসে সভ্য সমাজের হাতে ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। গণপিটুনির শিকার হচ্ছে যে মানুষগুলি, তাঁরা কোনও অপরাধ করে থাকতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে কি তাঁদের বিচারের অধিকার জনগণের আছে? তার জন্য পুলিশ প্রশাসন আছে, আইন আছে। সন্দেহজনক কোনও ব্যক্তিকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে বা তাঁর কথাবার্তা সন্দেহজনক মনে হলে তাঁকে অবিলম্বে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। কিন্তু তা না করে কিছু মানুষের নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া পরোক্ষে দেশের আইন ব্যবস্থার প্রতি এক তীব্র হুমকি ও প্রবল অমর্যাদা প্রদর্শন যা কখনও কাম্য নয়।
অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টিও বিশেষ ভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। গণপ্রহার চলাকালীন অনেকে স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে পুলিশে খবর দিলেও প্রশাসন জড়ভরতের মতো স্থবির হয়ে থাকে। এ ছাড়াও পুলিশের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে। যিনি পুলিশে খবর দিতে যান তাঁকে ধরেই পুলিশ টানাটানি করে। একের পর এক গণপ্রহারের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ প্রশাসন কোনও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে অক্ষম।
এখন প্রশ্ন, মানুষ এমন হিংস্র ও নির্মম হয়ে উঠেছে কেন? কেন মানুষ তুচ্ছ কারণে একটি অসহায় দুর্বল মানুষকে বেঁধে পিটিয়ে মারছে? এর নেপথ্যে কি কোনও মনস্তত্ত্ব কাজ করছে?
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে বেশিরভাগ মানুষই তীব্র ভাবে অসুখী। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, ভোগবাদী ব্যবস্থা সমাজকে গ্রাস করেছে। আর্থ-সামাজিক ভাবে সমাজের নিচুতলার মানুষের মনে সব সময় কাজ করে চলেছে এক ধরনের হতাশা, ক্ষোভ, ঘৃণা। আর সেই অপ্রাপ্তি থেকেই যখন একটি মানুষকে সামনে পাচ্ছে তখন মনের মধ্যে জমে থাকা যাবতীয় ক্ষোভ ঘৃণা উগরে দিচ্ছে তার উপরেই। ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব অনুযায়ী মানুষের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আদিম পাশবিক প্রবৃত্তি সুযোগ বুঝে উৎসারিত হয়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল শিক্ষিত সমাজ এ বিষয়ে একেবারে নিশ্চুপ। ছেলেধরা সন্দেহে হোক বা ডাইনি সন্দেহে হোক, এ কজন মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়া কখনও সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। হত্যা হত্যাই।
এক জন মারলেও হত্যা, দশ জন মিলে মারলেও হত্যা এবং তা অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ।
‘দুঃখজনক’ ঘটনা আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির ঘটনাগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার দিন আর নেই। ২০১৮ সালে গণপিটুনি বিরোধী রায়ের ভিত্তিতে সব রাজ্যকে আইন তৈরির নির্দেশ দিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় বিল পাশ হয়েছে। নয়া আইন অনুযায়ী, গণপিটুনির অপরাধ প্রমাণ হলে যাবজ্জীবন শাস্তি দেওয়া হবে, এমনকি গণপিটুনিতে মদত দিলেও কড়া শাস্তি দেওয়া হবে।
গণপিটুনি বর্তমানে সংক্রামক রোগ রূপে ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘ মেয়াদি আইন ব্যবস্থার প্রতি তীব্র অনীহা থেকে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নিচ্ছে। কিন্তু সভ্য সমাজে হাতে আইন তুলে নেওয়ার অধিকার কোনও ব্যক্তির নেই, কোনও সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠীরও নেই। গণপিটুনিতে মৃত্যুর সংবাদ শুনে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলে চলবে না। গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ তৈরি করতে হবে। গুজবের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে। গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সভ্য সমাজে গণপিটুনি নামক বর্বরতাকে কোনও ভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। সভ্য সমাজে এই নৃশংস আচরণ আদৌ বরদাস্ত করা যায় না। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সমাজের সব স্তরের মানুষকে গণপিটুনির বিরুদ্ধে একজোট হতে হবে। গণপিটুনির শিকার কাউকে হতে দেখলে নিজের হাত দু’টি দিয়ে সন্ত্রস্ত মানুষটিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। তবেই একে একে আরও অনেক হাত এসে সেই মানুষটির চারপাশে গড়ে তুলবে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বেঁচে যাবে একটা অসহায় প্রাণ। তবেই এই পৃথিবীকে আগামী দিনের শিশুদের কাছে বাসযোগ্য করে যাওয়ার অঙ্গীকার সফল হবে আমাদের।
শিক্ষিকা, মণীন্দ্রনগর
উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়
‘উত্তর সম্পাদকীয়’ বিভাগে
লেখা পাঠান এই ইমেল-এ
edit.msd@abp.in
ইউনিকোড হরফে লেখা পাঠালেই ভাল হয়। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।