মরাঠা ক্রান্তি মঞ্চের বিক্ষোভ। অওরঙ্গাবাদে।ফাইল চিত্র।
মরাঠা ক্রান্তি মোর্চার সৌজন্যে মরাঠাদের জন্য জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের দাবিটি এত দিনে যে জায়গায় পৌঁছাইয়াছে, সেখান হইতে পিছনে ফেরা অত্যন্ত কঠিন কাজ। দেবেন্দ্র ফডণবীসের সরকার মরাঠা সংরক্ষণের বিষয়টি দেখিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দেওয়া সত্ত্বেও আন্দোলনের পিছু হটার কোনও চিহ্নই নাই, বরং সাফল্যের ইঙ্গিতে যেন আন্দোলনের তীব্রতা উত্তরোত্তর বাড়িতেছে। রীতিমতো হিংসাত্মক রূপ লইয়াছে এই আন্দোলন, আগুন ও অস্ত্রের ব্যবহার চলিতেছে অবিরত। মরাঠা গোষ্ঠীভুক্ত পিতামাতারা শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানো বন্ধ করিয়া দিতেছেন— দাবির সন্তোষজনক মীমাংসা না-হওয়া পর্যন্ত নাকি এমন অসহযোগই চলিবে। পরিবহণ হইতে শুরু করিয়া অফিসকাছারি, স্বাভাবিক জীবন বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হিংসাত্মক আন্দোলনের দাপটে। বিষয়টি আরও গুরুতর আকার পাইয়াছে মরাঠা ক্রান্তি মোর্চার পিছনে প্রধান বিরোধী দলগুলি যোগ দেওয়ায়। সরকারপক্ষের পিঠ ঠেকিয়া গিয়াছে দেওয়ালে। বুঝিতে অসুবিধা হয় না, ২০১৯ সালের নির্বাচনের প্রস্তুতিতেই এই দলবিভাজন ও তজ্জনিত রাজনৈতিক প্ররোচনা-উন্মাদনা। প্রতিটি দল হিসাব করিতে ব্যস্ত, এই সংরক্ষণের দাবি কিংবা তাহার বিরোধিতা হইতে ভোটের বাক্সে কত সংখ্যা আসিবে ও যাইবে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, মরাঠা জাতির অর্থ মহারাষ্ট্রের জনসংখ্যার ৩২ শতাংশ। সমাজ-অর্থনীতিতে ইহাদের ক্ষমতাও যথেষ্ট। কোনও অর্থেই ইহাদের পশ্চাদপর জাতি বলিয়া ধরা যায় না। তবুও অর্থনৈতিক সুবিধার স্বার্থে দাবিটি দাঁড়াইয়াছে, সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি বা ওবিসি-র মধ্যে মরাঠাদের স্থান দিতেই হইবে।
মহারাষ্ট্রে ওবিসি বলিয়া যাহাদের ধরা হয়, তাহারা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ। একে তো অর্থনৈতিক সম্পদের দিক দিয়া মরাঠারা ইহাদের অনেক উপরে, জমিসম্পত্তির এক বিপুল অংশ মরাঠা দখলে, চিনিকলগুলির মালিকানার বড় অংশও মরাঠাদের। এমতাবস্থায় মরাঠাদের ওবিসি-গোত্রে স্থান দিলে বর্তমান ওবিসি-দের কর্মক্ষেত্র অকারণে আরও সঙ্কুচিত হইবে, এই আশঙ্কাটি তাই ভিত্তিহীন নয়। সুতরাং আপাতত ভোট-ময়দানে সরাসরি সংঘাত ওবিসি বনাম মরাঠাদের। সাধারণত ওবিসি-রা ঐক্যবদ্ধ ভাবে ভোট দেয় না, কিন্তু এ বার মরাঠা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়িয়া তেমন ঐক্যও উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতে পারে। কংগ্রেস ও এনসিপি যে হেতু মরাঠা দাবির পাশে দাঁড়াইয়াছে, ওবিসি-ভোট তাহাদের হাতছাড়া হইবার সম্ভাবনা। ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস কমিশনের রিপোর্টটি নভেম্বরে পেশ হইবার আগে পর্যন্ত রাজনীতির এই দড়ি-টানাটানি চলিবে।
তবে কিনা, প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ কথাটি এই সব ভোটগত বা শতাংশগত হিসাবপত্রের অনেক উপরে। মরাঠা সংরক্ষণের দাবিতে উত্তাল রাজনীতি আবার প্রমাণ করিল, ভারতীয় সমাজ এবং অর্থনীতিতে সংরক্ষণ নামক বিস্ফোরক বিষয়টি কত মৌলিক ভাবে পাল্টাইয়াছে। আগে সামাজিক ভাবে উচ্চজাতি নিচু জাতিদের জন্য সংরক্ষণকে আটকাইবার প্রয়াস করিত। এখন উচ্চজাতি নিজেদের জন্যই সংরক্ষণের দাবিতে সরব। অর্থাৎ সংরক্ষণের কার্যকারিতা মানিয়া লইয়া উচ্চজাতিগুলি নিজেদের জন্য সুবিধা আদায় করিবার অস্ত্র হিসাবে সংরক্ষণকে বাছিয়া লইতে ব্যস্ত। গুজরাতে পতিদার ও হরিয়ানায় জাঠদের পর এ বার মহারাষ্ট্রে মরাঠাদের আন্দোলন মনে করাইয়া দিতেছে ভারতের সংবিধান-রচয়িতাদের সতর্কবাণীর কথা। তাঁহাদের অনেকেই উপদেশ দিয়াছিলেন, অনগ্রসরতাকে সমাজগত বা গোষ্ঠীগত ভাবে না দেখিয়া অর্থনৈতিক মানদণ্ডে দেখিতে। ভারতের মতো বহুত্ব-অধ্যুষিত সমাজে সংরক্ষণের মতো এমন জাদুকাঠি তথা ঘুমন্ত দানবকে ছাড়িয়া দিলে ফল ভয়ানক হইতে পারে, ইহাই হয়তো তাঁহারা আশঙ্কা করিয়াছিলেন।