হাসপাতালে আনা হয়েছে এক জওয়ানকে। ছবি: এএনআই-এর টুইটার হ্যান্ডল থেকে নেওয়া
অচ্যুত সাহু কি জানিতেন না, চাকুরির শর্তরক্ষায় যে ভূখণ্ডে তিনি পা রাখিতেছেন, সেখান হইতে না-ও ফিরিতে পারেন তিনি? তবু, সেলফি তুলিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করিয়াছিলেন। কেহ বলিতে পারেন, ইহাই মনুষ্যধর্ম— প্রবল বিপদকেও মন ভুলিয়া থাকিতে পারে। কেহ অবশ্য একটি অন্য সম্ভাবনার কথাও বলিতে পারেন। হয়তো অচ্যুত ভাবিয়াছিলেন, সাংবাদিকদের সহিত তো মাওবাদীদের বিরোধ নাই, অতএব পেশাদারি পরিচয়েই তাঁহার, অথবা তাঁহাদের, জীবন নিরাপদ। ভাবনায় ভুল ছিল, প্রাণের মূল্যে টের পাওয়া গেল। মাওবাদীরা এমনই এক যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে, যেখানে দূতও অবধ্য নহে। দিনকতক পরে অবশ্য মাওবাদী নেতা বিবৃতি দিয়া জানাইয়াছেন, তাঁহারা সাংবাদিকদের মারিতে চাহেন নাই। ভুল হইয়া গিয়াছে। কিন্তু, সাংবাদিকদেরও পুলিশের সাহায্য লইয়া জঙ্গলে প্রবেশ করা উচিত হয় নাই। মাওবাদী নেতার ভাষায়, সাংবাদিকরা নির্ভয়ে, বিনা প্রহরায় ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে আসুন, সংবাদ সংগ্রহ করুন। এই অভয়বাণীতে বিশ্বাস করিবেন, এমন কেহ আছেন কি? বিশেষত, মাওবাদীরা বারে বারেই বুঝাইয়া দিয়াছে, তাহাদের লড়াইয়ে নৈতিকতার কোনও স্থান নাই। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হইতে সর্বার্থেই বহু দূরে থাকা নিরীহ নাগরিকদেরও তাহারা রেয়াত করে নাই। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধঘোষণা কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য হইতে পারে না। কিন্তু, সেই যুদ্ধেরও একটি ধর্ম থাকিতে পারিত, নীতি থাকিতে পারিত। মাওবাদীরা প্রমাণ করিয়াছে, সেই বালাই তাহাদের নাই।
তবে, শুধু মাওবাদীদের দিকে আঙুল তুলিলে খণ্ডদর্শন হইবে। ভারতে সাংবাদিকরা অতি সহজ শিকার। এমনই সহজ যে তাঁহাদের হত্যা করিলেও দুষ্কৃতীদের শাস্তি হয় না। একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষা বিষয়ে সমীক্ষা করিয়া থাকে। বিগত কয়েক বৎসর সেই সমীক্ষার রিপোর্ট বলিতেছে, বিশ্বের যে দেশগুলিতে সাংবাদিকদের সুরক্ষা ন্যূনতম, ভারতের নাম সেই তালিকার গোড়ার দিকে। বস্তুত, এমন আর কোনও প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ নাই যেখানে সাংবাদিকরা ভারতীয় সাংবাদিকদের ন্যায় বিপন্ন। সেই বিপন্নতার বৃহত্তম কারণ রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা। বেআইনি খাদান বিষয়ে তদন্তমূলক প্রতিবেদন লেখা বা কোনও সরকারি কর্তার দুর্নীতিতে জড়িত থাকিবার সংবাদ ফাঁস করিয়া দেওয়া সাংবাদিকের রহস্যজনক মৃত্যুর পর রাষ্ট্রযন্ত্র যতখানি উদাসীন থাকিতে পারে, কোনও নেতার পুত্রের গাড়ির চাকার তলায় প্রাণ হারানো সাংবাদিক যে ভাবে তলাইয়া যাইতে থাকেন পুলিশ ফাইলের পাহা়ড়ের নীচে, তাহাতে বোঝা যায়, এই মৃত্যুগুলি লইয়া বেশি নাড়াচাড়া হইলে ক্ষমতাসীনদের বিপদ। উগ্র হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে কলম তোলায় প্রাণ হারাইতে হয় গৌরী লঙ্কেশকে, পাকিস্তানের সহিত আলোচনার পথে হাঁটিবার কথা বলায় নিহত হন শুজাত বুখারি। শুধু হত্যাই নহে, সাংবাদিকদের হেনস্থা করিবার হরেক উপায় রাষ্ট্রের হাতে বর্তমান। দুর্ভাগ্য, ঘোষিত ভাবেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী মাওবাদীদের সহিত রাষ্ট্রযন্ত্রের ফারাক করা ক্রমে দুষ্কর হইতেছে। ইহা কি নেহাতই সমাপতন যে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতা আসিবার পরই সাংবাদিকরা আরও বেশি বিপন্ন হইয়াছেন?