সন্ধিৎসু: শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, ছাত্রছাত্রী, স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে বার্ষিক আলোচনাসভায় অমর্ত্য সেন, শান্তিনিকেতন। সৌজন্য: প্রতীচী ইনস্টিটিউট
অমর্ত্য সেন এই দেশকে কী দিয়েছেন? এ-প্রশ্ন আগে কখনও শুনিনি। ইদানীং মাঝে মাঝেই শুনছি। কান কামড়ে শোনানো হচ্ছে। প্রশ্নকর্তারা বলছেন, এর উত্তর জানতে গবেষণা করা দরকার। তা, যাঁদের দরকার, তাঁরা তো সেটা করতেই পারেন। গবেষণা শব্দটার আদিকল্পে গরু খোঁজার ব্যাপারস্যাপার থাকলেও কালক্রমে তার অর্থ অনেক দূর সম্প্রসারিত হয়েছে, এখন তার জন্য লেখাপড়া করতে হয়, চিন্তাভাবনা করতে হয়, সে-সব তো খারাপ কাজ নয়, করলে উপকারই হবে। কেন, কোথা থেকে, কী উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্ন আমদানি করতে হল, সেটা বুঝতে অবশ্য কোনও গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই প্রশ্নের দ্বারা অমর্ত্য সেনের প্রতি একটু কটাক্ষ করা গেল আর কী। তাঁর অপরাধ, তিনি কোদালকে কোদাল বলেন। এক বার নয়, বার বার বলেন। তাতে কোদালের রাগ হয়। রাগ বাড়ে। অতএব, চলো কোদাল চালাই। বাজে কথা খুঁড়ে খুঁড়ে ছুড়ে দিই সোনার বাংলার আকাশে বাতাসে।
যাক গে। বাজে কথা এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বার করে দেওয়ার জন্যেই আমাদের দুটো কান দেওয়া হয়েছে। তবে কিনা, আমরা তো এখন জানি, আবর্জনাও বেবাক ফেলে দিতে নেই, তাকে কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু তৈরি করতে হয়, তাতেই পৃথিবীর মঙ্গল। তাই দ্বিতীয় কানটি ব্যবহারের আগে নেহাত আজেবাজে কথাকেও একটি বার মনের মধ্যে সাঁতলে নেওয়া ভাল, যদি কোনও সৎকাজে লাগে। সেই রেসিপি প্রয়োগ করেই একটি নিতান্ত ব্যক্তিগত ভাবনার স্বাদ মিলল। মনে হল, দেশ কী পেয়েছে দেশ ভাবুক, কিন্তু অমর্ত্য সেনের কাছে নিজে অন্তত কী পেয়েছি, সেটা তো ভেবে দেখা যেতেই পারে। তাতে চিত্ত প্রসারিত হয়, আবর্জনার কটু গন্ধটাকে মন থেকে তাড়ানো যায়।
না, প্রাপ্তিযোগের তালিকা রচনার সাধ নেই, তার সাধ্যও নেই। বরং একটা গল্প বলা যাক। ২০০৫ সালের জুলাই মাস। স্যর দেশে এসেছেন, সম্ভবত অল্প কয়েক দিনের জন্য। কলকাতায় এক দিন সকালে ঘণ্টাখানেক তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়া গেল। সেটাই প্রথম সাক্ষাৎকারের সুযোগ। কিছু দিন আগে প্রকাশিত হয়েছে দি আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ান, সে-বইয়ের কিছু লেখা পড়েছি। বেশ চিন্তা-টিন্তা করে টেপ রেকর্ডার হাতে গেলাম তাঁর কাছে। প্রাথমিক কিছু আলাপের পরে বললেন, ‘হ্যাঁ, তা বলুন, কী প্রশ্ন।’ বইয়ের একটি অধ্যায় তথা প্রবন্ধের সূত্র ধরে জানতে চাইলাম, আমাদের দেশে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর শৈলী কি অতীতের তুলনায় অনেকটা যান্ত্রিক হয়ে গেছে? অমর্ত্য সেনের জবাবের প্রথম বাক্যটি ছিল, “এ রকম সমালোচনা আমি করতে পারব বলে মনে করি না।” বাকি উত্তরটি ওই প্রথম বাক্যের ব্যাখ্যা। শুনতে শুনতেই টের পেলাম, আমার প্রশ্নটা বহুলাংশে ভুল এবং মূলত অপ্রাসঙ্গিক।
একটু ঘাবড়ে গেলাম। দ্বিতীয় প্রশ্ন, এ দেশে উচ্চশিক্ষায় হিউম্যানিটিজ় বা মানবিকী বিদ্যাকে অবহেলা করে প্রযুক্তির ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়া হচ্ছে, এটা একটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে না কি? ব্যাপারটার কি কোনও গুরুত্ব আছে? স্যরের চোখটা একটু কুঁচকোল, বললেন, “যদি কথাটা ঠিক হয়, নিশ্চয়ই গুরুত্ব থাকতে পারে, কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর বিষয়ে আমার খুব কিছু বলার হক আছে বলে আমি মনে করি না। আমি এখানকার শিক্ষার যে দিকটা নিয়ে কিছুটা জানি, যে দিকটা নিয়ে আমাদের প্রতীচী ট্রাস্টের কাজ হচ্ছে, সেটা হল প্রাথমিক শিক্ষা।... (এখানকার কলেজে) কী ঘটছে না ঘটছে, সে বিষয়ে যতটা জ্ঞান থাকলে এ ধরনের প্রশ্নের জবাব দিতে পারতাম, সে ধরনের জ্ঞান আমার সত্যিই নেই। হঠাৎ বিদেশ থেকে এসে এখানকার শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে দিয়ে ধূমকেতুর মতো বেরিয়ে গেলাম, এটা আমি একেবারেই করতে চাই না।”
বিপন্ন বোধ করতে করতেই কোন দিকে যেতে হবে তার একটু আঁচ পেলাম এবং প্রশ্ন করলাম, প্রাথমিক শিক্ষাতেও কি এটা একটা সমস্যা নয় যে, আমরা ছোটদের স্বাভাবিক প্রশ্ন করার মনটাকে নষ্ট করে দিই? ছোটবেলা থেকে তর্কশীল করে তোলার কি কোনও উপায় আছে? জবাব এল, “নিশ্চয়ই আছে, তবে এ বিষয়ে খুব একটা প্রচণ্ড ঘাটতি আছে, এটা কিন্তু আমি মানছি না। আমাদের ঘাটতি আছে আরও অনেক বেশি মৌলিক জিনিস নিয়ে। যেমন স্কুল নেই। কিংবা স্কুল আছে, কিন্তু অনেক সময় শিক্ষকরা আসছেন না। অথবা এলেও, গা করছেন না।...” এই ভাবে বুঝিয়ে বলতে বলতে এক সময় তিনি বললেন, ‘যে ধরনের প্রশ্ন আপনি তুলছেন’ সেগুলো ‘নিশ্চয়ই থাকবে, কিন্তু আমি সেগুলোকে এখন খুব একটা জোর দিতে চাচ্ছি না। এইজন্যে চাচ্ছি না যে, অধিকাংশ বাঙালি বা ভারতীয় বাচ্চাদের একটা এডুকেশনের সম্ভাবনাই নেই। সে ক্ষেত্রে এই ধরনের জিনিসের ওপর জোর দেওয়াটা একটা শ্রেণিবিভক্ত চিন্তার পরিচয় বলে আমি মনে করছি।’
কথা আরও অনেকটা গড়িয়েছিল। আর, সেই কথার মধ্যে দিয়েই একটি প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলাম। সেটা এই যে, অনেক সমস্যা নিয়েই ভাবা যায়, আলোচনা করা যায়, কিন্তু প্রথমে জানা দরকার কখন কোন সমস্যাটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে, তার পরে সেই বিষয়ে গভীর অনুসন্ধিৎসা এবং শুশ্রূষা সহকারে যথেষ্ট তথ্য জেনে ও যথেষ্ট চিন্তা করে তবে নিজের ধারণা বা মতামত তৈরি করতে হবে, এবং সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করতে হবে। কথাটা শুনলে মনে হতে পারে, এ আর বলবার কী আছে, এ তো সবাই জানে। সবার খবর জানা নেই, কিন্তু নিজের কথাটুকু বলতে পারি: হাজার কথার ভিড়ে, লক্ষ সমস্যার অরণ্যে কোনটিকে অগ্রাধিকার দেব, কী নিয়ে ভাবব, সেটা ঠিক করা এবং সেই ঠিকটাকে ধরে এগোনো— এর থেকে কঠিন কাজ খুব কম আছে। আর সেই কারণেই অমর্ত্য সেনের কাছে পাওয়া জ্ঞানাঞ্জনশলাকাটিকে জীবনের পরম প্রাপ্তি বলে মনে করি। পনেরো বছর আগের সেই সকালে তিনি শিখিয়েছিলেন, পাঁচ রকম প্রশ্নের বিক্ষিপ্ত শাখাপ্রশাখায় পদচারণা না করে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটিকে কী করে চিনতে হয়। এক দিনে আর কতটুকুই বা শেখা যায়? আজও কি শিখেছি? কিন্তু যত বার তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি, তাঁর লেখা পড়েছি, বক্তৃতা শুনেছি, তত বারই নতুন করে উপলব্ধি হয়েছে, পাখির চোখ দেখতে শেখা কতটাই জরুরি।
অমর্ত্য সেন পাখির চোখ দেখেন এবং দেখতে শেখান বলেই তাঁকে নিয়ে বর্তমান শাসকদের এত রাগারাগি। নোটবন্দি থেকে কৃষি বিল পর্যন্ত একের পর এক উপলক্ষে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় সমালোচনা করেছেন, সেটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। এই শাসকদের রাজনৈতিক দর্শন এবং প্রকল্পটিকেই তিনি সর্বনাশের পথ বলে মনে করেন, এবং সে-কথা বারংবার জোর গলায় ঘোষণা করতে তিনি দ্বিধা করেননি। তাঁর এই দ্বিধাহীন এবং আপসহীন অবস্থানের কারণে অনেকেই, এমনকি তাঁর অনুরাগীদের একাংশও দেখেছি বেশ খুঁতখুঁত করেন। তাঁদের প্রশ্ন, উনি যে উচ্চতায় আছেন, তাতে এতটা সরাসরি রাজনৈতিক মন্তব্য করা কি ঠিক? নোবেলজয়ী পণ্ডিত কি এতদ্দ্বারা নিজের প্রতি অবিচার করছেন না? তাঁকে এ বিষয়ে কখনও জিজ্ঞাসা করিনি, কোনও দিন করবও না, স্পর্ধা যে আসলে নির্বুদ্ধিতার আর এক নাম, সেটুকু জানা আছে। কিন্তু তাঁর সম্বন্ধে যতটা ধারণা আছে তাতে মনে হয়, তিনি ওই আপত্তিটাকে একেবারেই গ্রাহ্য করেন না। নোবেলজয়ী— কিংবা ভারতরত্ন— তাঁর বহু পরিচিতির অন্যতম, তার দায় মেটাতে গিয়ে এক জন সচেতন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে, এবং এক জন সজাগ বিশ্বনাগরিক হিসেবেও, তাঁকে ভারতের রাজনীতি ও সমাজের এই ভয়াবহ বিপন্নতার সামনে মুখ বুজে থাকতে হবে, এমন উদ্ভট আবদার তিনি গ্রাহ্য করবেনই বা কেন? যা নিয়ে ভাবা দরকার এবং সেই ভাবনার কথা যে ভাবে বলা দরকার, সেটা যদি তাঁর মতো অগ্রপথিক আমাদের শিখিয়ে না দেন, তা হলে চলবেই বা কী করে?
এই মুহূর্তের ভারতে, এবং পশ্চিমবঙ্গে, দাঁড়িয়ে আমরা কী ভাবব, কী দেখব, কী বলব, তার অগ্রাধিকার নির্ধারণে ভুল করলে সর্বনাশের পথ প্রশস্ত হবে। কোটি কোটি শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগটুকুই দেওয়া না গেলে উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আলোচনায় মগ্ন থাকাটা যেমন সুবিবেচনার কাজ হতে পারে না, তেমনই সুস্থ সমাজ এবং গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভিতটাই যখন ধ্বংসের মুখোমুখি এসে পড়ে, তখন অন্য নানা কূটতর্ক সরিয়ে রেখে সর্বাগ্রে তাকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলেই কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ভারতের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে বলতে প্রশ্ন করেছিলাম, “এখন কী করণীয়?” অমর্ত্য সেন তার উত্তরে বলেছিলেন, “এটা খুব দুঃখের কথা যে, আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, আমরা এখানে পৌঁছেছি। এখন যে অবস্থা, সেটা তো মোটামুটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলায় পড়ে যাওয়া বলতে পারি। এখন যদি বলা হয় যে, এখানে থাকলে চলবে না, ওপরে উঠে সমতল, উর্বর জমি চাষ করতে হবে, সেটা খুবই ভাল কথা, কিন্তু আগে এই ক্যানিয়ন থেকে বেরোতে হবে তো!”
বেরোতে চাই কি না, সেটা অবশ্য প্রথম প্রশ্ন।